১০ ঘণ্টার দুই অর্ধে পুরো দিন, ফ্রান্সে চালু হয়েছিল যে-ঘড়ি

“সময় চলিয়া যায়- নদীর স্রোতের প্রায়”। এই সময়ের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে লড়ে যাচ্ছে মানুষ। কীভাবে যেন চলে যায় দিনের চব্বিশ ঘণ্টা? যদি আরেকটু সময় পাওয়া যেত হাতে, এই আকাঙ্ক্ষা সম্ভবত পৃথিবীর প্রত্যেকের। তবে আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে ফ্রান্সে (France) চালু হয়েছিল এক অদ্ভুত নিয়ম। দশ ঘণ্টার দুটি অর্ধে ভাগ করা হয়েছিল গোটা দিন। তাতে কি সময় বাঁচানো গেছিল? তা যায়নি, তবে মনে করা হয়েছিল এতে সহজ হবে হিসেবনিকেশ। আর শুধু ঘণ্টা তো নয়, মিনিট, সেকেন্ড, এমনকি মাসের তালিকাও বদলে গেছিল সেই হিসেব অনুযায়ী।

পৃথিবীর প্রতিটি প্রাচীন সভ্যতাতেই সময় পরিমাপের পদ্ধতি ছিল স্বতন্ত্র। বিজ্ঞান আর পুরাণের আশ্চর্য মিশেল দেখতে পাওয়া যায় সেখানে। গ্রিস, মিশর, ব্যাবিলন বা বৈদিক সভ্যতার মানুষ সময়কে বিভক্ত করে নিয়েছিল নিজস্ব প্রয়োজন অনুযায়ী। আবার, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নজরে আসে একাধিক পদ্ধতির মিলও। অনুমান করা হয়, বর্তমানের ৬০ সংখ্যাটিকে ধরে সময় মাপার ‘সেক্সাগেসিমাল পদ্ধতি’-র সূচনা হয় সুমেরিয়ান সভ্যতায়, পরে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার হাত ধরে সেটি বিস্তারিত রূপ নেয়। অবশ্য এই নিয়ে মতবিরোধও আছে কমবেশি। সে যাই হোক না কেন, সময়ের এই পদ্ধতিতেই এখন মেনে চলা হয় বিশ্বের সর্বত্র। ৬০ সেকেন্ডে এক মিনিট, ৬০ মিনিটে এক ঘণ্টা, আর ২৪ ঘণ্টায় এক দিন—সহজ হিসেব।

তবে আঠারো শতকে কয়েকজন ফরাসি আপত্তি জানিয়েছিলেন এ বিষয়ে। ১৭৫৪ সালে গণিতবিদ জঁ লে রন্ড আলেম্বার্টের মনে হয় সময়ের প্রতিটি একক বিভাজ্য হওয়া উচিত ১০ দিয়ে। তাতে আরো সহজ হবে হিসেবনিকেশ। যদিও পরের বেশ কিছু বছর কোনো উচ্চবাচ্য করা হয়নি এই প্রস্তাব নিয়ে। ১৭৮৮ সালে ক্লদে বোনিফেস আবার শিরোনামে নিয়ে আসেন একে। তাঁর মত অনুযায়ী, সমগ্র দিনকে ভাগ করতে হবে ১০ ঘণ্টার দুটি অর্ধে। প্রতি ঘণ্টায় থাকবে ১০০ মিনিট এবং প্রতি মিনিটে ১০০০ সেকেন্ড। এমনকি সপ্তাহ হবে ১০ দিনে। জঁ চার্লস দে বোর্ডা আরো নিপুণ করে তোলেন এই পরিকল্পনা। অবশেষে ১৭৯৩ সালের ২৪ নভেম্বর চালু হয় ২০ ঘণ্টার দিন।

প্রাথমিকভাবে সমস্যায় পড়লেও ঘড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি দ্রুত মানিয়ে নেয় ‘ডেসিমাল’ (Decimal Clock) প্রথার সঙ্গে। পুরনো আর নতুন দুইরকম পদ্ধতিই থাকত ঘড়ির মধ্যে। যদিও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রথা থেকে বেরিয়ে নতুনভাবে সময় বুঝে নিতে হিমশিম থেকে থাকে ফরাসিরা। ততদিনে ঘটে গেছে ফরাসি বিপ্লব (French Revolution)। অনেকের মনে হয়, ঘড়ির সময় বদলানো বিপ্লবীদের কোনো বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। তাদের ধারণা সত্যি করে চালু হয় ‘ফ্রেঞ্চ রিপাবলিকান ক্যালেন্ডার’। যেখানে মাসের তিরিশ দিনকে ভাগ করা হয় তিন ভাগে। ফলে বছর হয়ে যায় ১০ মাসের। নতুন নাম রাখা হয় মাসগুলির। কিন্তু তাতে সমস্যা দেখা দেয় বছরের বাকি পাঁচটি দিন নিয়ে। তাকে তো কিছুতেই আনা যাচ্ছে না দশের বিভাজ্যরূপে। আরো সমস্যা হয় লিপ ইয়ারে। এদিকে কলকারাখানার শ্রমিকরাও ক্রুদ্ধ হন নতুন নিয়মে। এখন নয়দিন কাজ করলে তবে একদিন ছুটি মেলে। অবশেষে মাত্র ১৭ মাসের মধ্যে বন্ধ করে দিতে হয় এই ঘড়ি।

আরও পড়ুন
গুজব ছাপিয়ে গেছে ইতিহাসকে, আজও সক্রিয় ৬০০ বছর পুরনো ঘড়ি

অবশ্য তারপরেও ফ্রান্সে বারবার ফিরে এসেছে ‘ডেসিমাল’ ঘড়ির প্রস্তাব। ১৮৯০ আর ১৮৯৭-তে চেষ্টা করা হয় নতুন করে। দুবারই খারিজ করে দেওয়া হয় সেই পরিকল্পনা। ফলে পুরনো প্রথা মেনেই আজও চলছে ফ্রান্সের ঘড়ি। সময় বদলানো বিষয়টি সত্যিই বেশ ঝক্কির ব্যাপার!

আরও পড়ুন
উল্টোদিকে চলে কাঁটা, বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসছে ঐতিহ্যবাহী ‘আদিবাসী ঘড়ি’

Powered by Froala Editor