আমরা জানি, বিভিন্ন রাজার হাতে থাকা, বিভিন্ন ভূখণ্ড এক-এক সময়ে ভারতের অংশ হয়েছে। তেমনি বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ১৫ আগস্টের পরেও তাঁদের ‘স্বাধীনতার’ লড়াই চালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। অর্থাৎ, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট কিন্তু ভারত ভূখণ্ডের সকল অধিবাসী একসঙ্গে ‘স্বাধীন’ হননি।
তাঁরা কারা? প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। এমনই এক জনগোষ্ঠী ভারতের এলজিবিটি মানুষেরা। ভালো বাংলায় বলতে গেলে, যৌনতা এবং লিঙ্গ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তাঁদের ভারতীয় হিসাবে স্বীকৃতি লাভ হয় ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর!
হ্যাঁ, এর আগে অব্দি তাঁদের পরিচয় ছিল ‘অপরাধী’ হিসেবেই। ঠিক যেমন একটা সময় অব্দি স্বাধীন ভারতে ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’ হিসাবে ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী গুজ্জার, নট, বেদীয়া, দেবদাসী ইত্যাদি বেশ কিছু সম্প্রদায় অপরাধী হওয়ায় দেশের নাগরিক অধিকারের আওতার বাইরে ছিলেন। তবে সে-প্রসঙ্গ অন্য কোনোদিন। আজকের মূল বক্তব্য ভারতের লিঙ্গ এবং যৌন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়ে।
২০১৮ সালে, প্রায় তিন দশকের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে শেষ পাথরটি উপড়ানো গেল। ব্রিটিশরাজের ৩৭৭ ধারার বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ, যাঁরা ১৯৪৭ সালের পরেও সাত দশক স্বপরিচয়ে ভারতীয় হিসাবে স্বীকৃত ছিলেন না, নাগরিক স্বীকৃতি পেলেন। এতদিন শুধুমাত্র তাঁদের ভালোবাসার পছন্দের ধরনের জন্য, লিঙ্গ পরিচয়ের জন্য ‘অপরাধী’ তকমার নিচে আটক ছিলেন। এতদিনে সুবিচার পেলেন তাঁরা।
এই স্বাধীনতার পরের পশ্চিমবঙ্গের প্রথম বিধানসভা নির্বাচন সামনের বছর। সাংবিধানিক স্বাধীনতা আসলেও, বাকি আছে হাজারো সামাজিক অধিকার। অপরাধী তকমা ঘুচেছে, কিন্তু দুইজন সমপ্রেমী বা লিঙ্গাতরকামী ভারতীয় কোনো আইনবলেই বিয়ে করতে পারবেন না আজকের দিনেও! ওটিতে এখনো বিষমকামী পুরুষ এবং মহিলাদেরই অধিকার।
ভাবতে পারেন, ২০২০ সালের ভারতে এমন লক্ষ লক্ষ মানুষ আছেন যাঁরা নিজেদের ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে ঘর বাঁধতে পারবেন না! পাবেন না জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনীর স্বীকৃতি। ফলত পাবেন না নিজেদের অর্জিত সম্পত্তির অধিকার। কোনো ব্যাঙ্ক এই সম্পকের ভিত্তিতে জয়েন্ট একাউন্ট খুলতে দিতে পারবেন না। নেই সন্তান ধারণের, পালনের অধিকার। দত্তক নেওয়ার অধিকারই বা কই!
আরও পড়ুন
কলকাতার বাসে চালু হচ্ছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য সংরক্ষিত আসন
শুনলে অবাক হবেন, জাতীয় রক্তদান নীতি অনুযায়ী এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষের স্ব-পরিচয়ে রক্তদানের অধিকারও নেই! এমন আরো অনেক সিভিল রাইটস এই মুহূর্তে ভারতের এলজিবিটি মানুষের অধরা!
প্রশ্ন হচ্ছে, রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলি কতটা তৎপর এঁদের অধিকারের প্রশ্নে?
শেষ জাতীয় নির্বাচনের সময় বামপন্থী দলগুলির কিছু, নির্দিষ্ট করে ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি তাদের প্রতিশ্রুতিপত্রে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের অধিকারের দাবিগুলো যুক্ত করেছিল। একই সঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, গণ সংগঠনগুলিও নির্বাচনের বাইরের সামাজিক আন্দোলনের প্রশ্নে ধারাবাহিকভাবে এই দাবি দাওয়া নিয়ে জমিতে থাকবে। বর্তমানে ভারতের ছাত্র ফেডারেশন বা SFI এই কাজে কিছুটা হলেও গুরুত্ব দিচ্ছে।
আরও পড়ুন
কৃষ্ণাঙ্গ ও সংখ্যালঘুদের মুখ ফুটে উঠবে ব্রিটেনের মুদ্রায়, থাকছেন দুই ভারতীয়ও
বর্তমান সরকারের শাসনে শুরুতেই পশ্চিমবঙ্গে ট্রান্সজেন্ডার উন্নয়ন বোর্ড তৈরি হলেও, তার কাজে তৎপরতার অভাব যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। তবে একই সঙ্গে বলা উচিত, সাম্প্রতিক কয়েক মাসে স্বাস্থ্য, খাদ্য সুরক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে রাজ্য সরকারের নেওয়া বেশ কিছু পদক্ষেপ এই বিষয়ে প্রশংসার দাবিদার। যদিও গণ সংগঠনগুলির কাজে বর্তমান সরকারের এই প্রচেষ্টা এখনো চোখে পড়েনি।
রাজ্যের জাতীয় কংগ্রেস এবং রাজ্য বিজেপি এই বিষয়ে একেবারেই নিশ্চুপ, তাঁদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে!
শেষে একটা কথা বলা জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলি বঞ্চিত অংশের জনগণের অধিকার রক্ষায় কতটা সচেষ্ট, তা কিন্তু বৃহত্তর জনমানসে একটি সমানুভূতির অভিঘাতও তৈরি করে। তা ভোটবাক্সে প্রতিফলিতও হয়।
আরও পড়ুন
পৃথিবীতে প্রথমবার, স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে স্বীকৃতি পেলেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাও
সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনে পুলিশের এবং তৎকালীন শাসক দলের ভূমিকা যে শুধু প্রান্তিক চাষিদের বৃত্তের ভিতরেই আটকে থাকেনি, ৩৪ বছরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাম জমানার পতন তার ঐতিহাসিক নিদর্শন।
রাজনৈতিক দলগুলি ইতিহাস সচেতন তো? উত্তর তোলা থাকল ২০২১-র ভোট বাক্সের জন্য!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor