মাত্র কয়েকদিন আগেই চলে গেল আরও একটা বিজয়া দশমী। পুজো আসার আগে বাঙালি যেমন মেতে ওঠে আনন্দে, এই দিনটিতে তেমনই বিষাদ নেমে আসে। সেই কবে থেকে বাঙালি জীবনের অঙ্গ দুর্গাপূজা। এতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে, যে একাত্তরের উত্তাল সময়ও পুজো বন্ধ হয়নি। কেমন ছিল সেই দিনগুলো?
১৯৭১— সালটা বাংলাদেশের কাছে বটেই, বাঙালির ইতিহাসেও অন্যতম উল্লেখযোগ্য। স্বাধীন হওয়ার জন্য যতই মরিয়া হয়ে উঠছে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশ, ততই আঘাত নেমে আসছে তাদের ওপর। প্রাণের ভয়ে লোকেরা চলে যাচ্ছে অন্য জায়গায়। পরিস্থিতি যখন এইরকম, তখন দুর্গাপূজা হবে কিনা, তা নিয়ে দেখা দিল সংশয়। ভেতরে একেবারে যে পুজো হয়নি, তা নয়। তবে সেটা হয়েছিল অনেক নীরবে। এদিকে নিজেদের ‘পরিচ্ছন্ন’ ভাবমূর্তি বজায় রাখতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাষ্ট্রীয় দুর্গাপুজো আয়োজন করল। ক্রমাগত হিন্দু শূন্য হতে থাকায়, জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হল কিছু বন্দীকে। একদিকে লুকিয়ে পুজো হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারিভাবেও ভাবমূর্তি বজায় রাখতে হচ্ছে দুর্গাপূজা।
এ তো গেল বাংলাদেশের ভেতরের কথা। সেই সময় উদ্বাস্তু এবং শরণার্থীদের পরিস্থিতিও ছিল ভয়াবহ। যে মানুষগুলো আগের বছরেই প্রাণ খুলে উৎসবে মেতেছিল, তখন তাঁরা সহায়সম্বলহীন। তাও পুজো থেকে তাঁরা কেউই সরে আসেননি। কলকাতা সহ অন্যান্য জায়গার শরণার্থী শিবিরে নিজেদের মধ্যে থেকেই সামান্য চাঁদা তুলে, রেশনের টাকা বাঁচিয়ে পালিত হয় দুর্গাপূজা। কুমারটুলির বদলে কালীঘাট থেকে আসে প্রতিমা। শরণার্থী শিবিরগুলোতে কারোর পরনে নতুন জামা-জুতো নেই, ক্লিশে মুখে শুধু উজ্জ্বল হয়ে আছে পুজোর সামান্য আনন্দটুকু। ভারতের সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষরাও এগিয়ে এসেছিলেন এই আয়োজনে। কিনে দিয়েছিলেন প্রায় লক্ষাধিক টাকার নতুন জামাকাপড়।
থিম পুজো এখনকার সময় এত জনপ্রিয় হলেও, সেই ’৭১-এর সময় কিছু মণ্ডপে দেখা গিয়েছিল থিমের ছোঁয়া। শরণার্থীদের কাছে রক্ষাকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তাই অনেক প্রতিমার মুখের আদল ভারতের প্রাক্তন এই প্রধানমন্ত্রীর আদলে করা হয়েছিল।
সবচেয়ে বড় কথা, সেই সময় কলকাতার অনেকগুলি মণ্ডপে দেবতার আসনে আরও একজন জায়গা করে নেন। তিনি শেখ মুজিবর রহমান। সেসময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার কলকাতায় এমনভাবে এসে পৌঁছেছিল যে, পুজোর উদ্যোক্তারাও এড়িয়ে যেতে পারেননি বঙ্গবন্ধুকে। সেবার ‘ধর্ম নষ্ট’ হওয়ার চিরাচরিত ‘ভয়’ থেকে বেরিয়ে এসেছিল বাঙালি। শেখ মুজিবের মধ্যেই সেই দেবতাকে দেখতে পেয়েছিলেন তাঁরা। অনেকে এমনও বিশ্বাস করতেন, বাঙালিদের রক্ষা করার জন্যই আবির্ভাব শেখ মুজিবুর রহমানের। কলকাতার বেশ কয়েকটি মণ্ডপের ভেতরে রাখা ছিল তাঁর প্রতিকৃতি। কোনো শরণার্থী শিবিরের দুর্গাপূজায় আবার দেবীর হাতে অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে ছিল বঙ্গবন্ধুর ছবিও! বস্তুত, তখন বঙ্গবন্ধুর ধর্ম নিয়ে আলাদা করে চিন্তা করেইনি বাঙালি। তাঁর ব্যক্তিত্বই পূজনীয় হয়ে উঠেছিল সবার কাছে।
তারপর কেটে গেছে এতগুলো বছর। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভাবলে, খানিক অবিশ্বাস্যই লাগে এসব কাহিনি। কিন্তু সেবার দুর্গাপুজো আর বঙ্গবন্ধু যে এক হয়ে গিয়েছিলেন অনেকের কাছে, ইতিহাস তার সাক্ষী। এই দুজনকে আঁকড়েই সাহস পেতে চাইছিলেন ওপার বাংলা থেকে আসা অসহায় শরণার্থীরা। প্রার্থনা ছিল একটাই, খানসেনার কবল থেকে যেন মুক্ত হয় প্রিয় বাংলাদেশ।
তারপরের ঘটনা সবারই জানা। ১৬ ডিসেম্বর, বিজয় দিবসের সেই দিন...
(ঋণ - চৌধুরী শহীদ কাদের, bdnews24.com)