বিশ্বভারতী, রবীন্দ্রনাথ তো রয়েছেই; সেইসঙ্গে শান্তিনিকেতনের আরও একটি বিশেষ আকর্ষণ হল সোনাঝুরির হাট। শুধু এই হাটের টানেই দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসে বহু মানুষ। কিন্তু খোয়াইয়ের এই হাটের কারণেই ওষ্ঠাগত স্থানীয় মানুষের প্রাণ। একদিকে যেমন চলছে অবৈধ জমি দখল, তেমনই বিপর্যয়ের সম্মুখীন গ্রামের প্রাচীন আদিবাসী সংস্কৃতিও। আর সেই মর্মেই গতকাল সম্মিলিত সভার আয়োজন করলেন গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দারা।
যত দিন যাচ্ছে, ততই যেন বেড়ে চলেছে পর্যটক সংখ্যা। আর পর্যটকদের ভিড় সামাল দিতেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হোটেল, ঝাঁ-চকচকে রিসর্টের সংখ্যা। অধিগৃহীত হচ্ছে স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষদের জমি। যেখানে বাণিজ্যিক নির্মাণ কিংবা বিক্রি সম্পূর্ণ আইনবিরুদ্ধ। স্থানীয় বাসিন্দা এবং শিক্ষক শিবু সোরেন জানালেন, “খোয়াইয়ের একাবারে লাগোয়া যে সব রিসর্ট আছে, তার বেশিরভাগই মালিকদের নামে নেই। আদিবাসীদের ভুল বুঝিয়ে তাঁদের থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে এইসব জমি। তারপর বেনামে তৈরি হচ্ছে রিসর্টগুলি। এই বিষয়ে তথ্যের জন্য আমরা আরটিআই-এর আবেদনও করব বলে ঠিক করেছি।”
এখানেই কি শেষ? বৃহত্তর অর্থে এই হাটের বর্তমান বিবর্তিত চরিত্র ভয়ঙ্কররকম প্রভাব ফেলছে স্থানীয় মানুষের যাপনে। পর্যটকদের আনাগোনায় সোনাঝুরির রাস্তায় যানজট লেগেই রয়েছে। সে পথ দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদেরই যাতায়াতই এখন দুরূহ হয়ে উঠেছে। “পরিস্থিতি এমনই যে, কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়ে”, বলছিলেন শিবু সোরেন।
এর পাশাপাশি রয়েছে তরুণ পর্যটকদের বিশৃঙ্খলতাও। মদ্যপান তো বটেই, সেইসঙ্গে তাদের কুরুচিকর আচরণের শিকার হচ্ছেন গ্রামবাসী মহিলারা। কখনো কখনো এসবের সঙ্গে জড়িত থাকে রিসর্টের কর্তৃপক্ষও। টাকার প্রলোভন দেখিয়ে আদিবাসী মহিলাদের রিসর্টে বাধ্য করা হয় নাচতে। ক্ষোভ ঝরে পড়ল শিবু সোরেনের কণ্ঠস্বরে, “এই নাচ কিংবা আদিবাসী গানের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহ্য। বিশেষ পরবেই একমাত্র এইধরণের নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অথচ প্রতিদিন পর্যটকদের আনাগোনায় তাঁদের বাধ্য করা হচ্ছে নাচতে। তাছাড়া স্থানীয় কিশোরদের মননেও প্রভাব ফেলছে বর্তমান পরিস্থিতি।”
আরও পড়ুন
স্পঞ্জ আয়রন কারখানা কর্তৃক অবৈধ জমি অধিগ্রহণ, প্রশাসনকে জানিয়েও অধরা সুরাহা
সোনাঝুরির এই হাট সকলের কাছে পরিচিত আরও একটি নামে— শনিবারের হাট। কিন্তু বর্তমানে সোম থেকে রবি প্রতিদিনই নিয়মিত বসছে এই হাট। বিরাম নেই কোনো। তবে ‘হাট’ বলতে গেলেও খানিকটা ধন্দের মধ্যে পড়তে হয়। কারণ ‘হাট’-এর আর কোনো চরিত্রই বজায় নেই সেখানে। কলকাতা থেকে গাড়ি বোঝাই করে আসছে বাণিজ্যিক সামগ্রী। তারপর তা দেদার বিকোচ্ছে খোয়াইয়ে। একটা সময় এই হাটই ত্রাতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল গ্রামবাসীদের। মূলত কলাভবনের বিভিন্ন শিক্ষার্থী এবং গ্রামবাসীদের হাতে তৈরি পণ্যই বিক্রি হত শনিবারের হাটে। বর্তমানে বাইরের বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থার দাপটে বন্ধ হয়েছে সেই উপার্জনের পথও। আর দূষণ তো রয়েইছে। প্লাস্টিক, আবর্জনা, বর্জ্য পদার্থ— সেসব ফেলা হচ্ছে জঙ্গলেই। এককথায় যেন সবদিক থেকেই কোণঠাসা করে দেওয়া হচ্ছে অরণ্যের ভূমিপুত্রদের।
আরও পড়ুন
জমি অধিগ্রহণ, প্রকৃতি-নিধন করে নির্মাণকাজ; প্রতিবাদে লং মার্চ ম্রো জনগোষ্ঠীর
এই আগ্রাসন রুখতেই গতকালের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বন্ধ করা হবে খোয়াইয়ের হাট। এই মর্মে আগামী কাল ২৫ মার্চ ডেপুটেশন জমা দেওয়া হবে জেলাশাসকের কাছে। এমনটাই জানালেন শিবু সোরেন।
সমাজকর্মী মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা থেকে জানা গেল, বিশ্বভারতী দোল উৎসব বন্ধ রাখলেও এই রিসর্টগুলি ইতিমধ্যে ঘোষণা করে দিয়েছে সেখানে আয়োজিত হবে বসন্ত উৎসব। শুরু হয়ে গেছে বুকিংও। অর্থাৎ, এই মহামারীর আবহেও যেন নিস্তার নেই গ্রামবাসীদের। “ভাবতেই ভয়ঙ্কর লাগছে এটা। গোটা এলাকাটাকেই যেন সব রকমভাবে দূষিত করে ফেলছে এই হাট। কিন্তু এই লড়াই যে খুব কঠিন হবে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। কারণ এই হাটের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে কিছু মানুষের কোটি কোটি টাকার স্বার্থ”, বলছিলেন মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও উপস্থিত ছিলেন গতকালের সভায়।
আরও পড়ুন
পাঁচতারা হোটেলের জন্য জমিদখল, প্রতিবাদে সরব বাংলাদেশের প্রাচীন জনগোষ্ঠী ‘ম্রো’-রা
এই অরাজকতা বন্ধ করতেই আগামীকাল থেকে আন্দোলনের পথে নামছেন গ্রামবাসীরা। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি-বিজড়িত এই হাট বন্ধ হয়ে যাক, তা মনে-প্রাণে চান না কেউ-ই। কিন্তু তা সত্ত্বেও শুধু অস্তিত্বরক্ষার লড়াইতে টিকে থাকার জন্য বাধ্য হয়েই বেছে নিচ্ছেন তাঁরা এই পথ। এর শেষ পরিণতি যে কী, তা জানা নেই কারোরই। তবে খোয়াইয়ের চিরাচরিত শান্তিময় পরিমণ্ডল ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর তাঁরা…
Powered by Froala Editor