১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আসছেন তিনি, সাঁওতাল রমণীর ছদ্মবেশে। সীমানা পেরোনোর আগেই, রোহনপুর রেল স্টেশনে ধরা পড়ে গেলেন পুলিশের হাতে। নিয়ে আসা হল নাচোল স্টেশনে। তারপর টানা চারদিন অকথ্য নির্যাতন পুলিশের। বুটের আঘাত, নগ্ন করে প্রহার, খেতে না দেওয়া, ধর্ষণ – বাদ গেল না কিছুই। এসবই স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা। তবু মুখ খুললেন না তিনি। সহ্য করলেন যাবতীয় পাশবিক অত্যাচার। তিনি, ইলা মিত্র। পূর্ব পাকিস্তানে কৃষক সংগ্রামের নেত্রী।
স্বামী রমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে ১৯৪৬-৪৭ সালে তিনি জড়িয়ে পড়েন তেভাগা আন্দোলনে। কৃষকের ফসল কৃষকেরই থাকবে, জোতদার বা জমিদারের করায়ত্ত হবে না সেই ফসল – এই দাবিতে রাজশাহী জেলার রামচন্দ্রপুর হাটে কৃষকদের সংগঠিত করতে থাকেন তাঁরা। দেশভাগের পরও, ছেড়ে আসেননি ভিটে। রয়ে গিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানেই। সেখানেই কৃষকদের একত্রিত করে আন্দোলন গড়ে তোলেন। শুরু হয় ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। দেশভাগের পর, মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কমিউনিস্ট পার্টিকে। চণ্ডীপুরের নাচোল গ্রামে আত্মগোপন করলেন রমেন্দ্র ও ইলা। সেখানে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হলেন মাতলা মাঝি। শুরু হল নতুন এক অধ্যায়।
মাতলা মাঝি ছিলেন প্রথম সাঁওতাল কমিউনিস্ট। তাঁর সঙ্গে রমেন্দ্র ও ইলা মিত্র একত্রিত হয়ে, ১৯৫০ সালে তেভাগা আন্দোলন কার্যকর করেন নাচোলে। সাঁওতাল ও ভূমিহীনদের একত্রিত করে গড়ে তোলেন তীরন্দাজ ও লাঠিয়াল বাহিনী। বিপদে পড়লেন স্থানীয় জোতদার ও জমিদাররা। আন্দোলন দমনের জন্য আবেদন গেল সরকারের কাছে। সরকারের পুলিশ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল নাচোলের গ্রামগুলিতে। অত্যাচার শুরু হল নিরীহ কৃষকদের ওপর, বন্দি করা হতে লাগল তাঁদের।
৫ জানুয়ারি, পুলিশ কনস্টেবলদের নিয়ে হাজির হল চণ্ডীপুর গ্রামে। গ্রামবাসীরা পুলিশকে ঘেরো করে বিক্ষোভ জানাতে শুরু করলে, একসময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় পরিস্থিতি। একজন পুলিশ কর্তা ও ৫ জন কনস্টেবলকে হত্যা করেন উন্মত্ত গ্রামবাসীরা। দু’দিন পর, সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ। সঙ্গে আসে সেনাও। গ্রাম ঘেরাও করে, তছনছ করা হয় সবকিছু। গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় অসংখ্য গ্রামবাসীকে। অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাননি নারী ও শিশুরাও। প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে পিছপা হন গ্রামবাসীরা। মাতলা মাঝি ও রমেন্দ্র মিত্র গা ঢাকা দিয়ে চলে আসেন ভারতে। সীমানা পেরোনোর আগেই, ধরা পড়ে যান ইলা মিত্র।
পুলিশের অত্যাচারের কথা পরবর্তীকালে নিজেই জানিয়েছিলেন তিনি। বন্দুকের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করা, দু’পায়ের মধ্যিখানে লাঠি রেখে চাপ দেওয়া, যৌনাঙ্গে গরম ডিম ঢুকিয়ে দেওয়া – বাদ ছিল না কিছুই। এমনকি গোড়ালিতে লোহার পেরেকও পুঁতে দিয়েছিল পুলিশ। বাদ যায়নি ধর্ষণও। তবু একটিবারের জন্যেও মুখ খোলেননি ইলা। হাঁটাচলার শক্তি হারিয়েও অদম্য জেদের বশে অস্বীকার করে গেছেন সব অভিযোগ।
বিচারের পর, আদালত ইলা মিত্র’কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। পরে সেই সাজা কমানো হয় ১০ বছর। রাজশাহী জেলে পাঠানো হয় তাঁকে। ওদিকে পুলিশের অত্যাচারে ততদিনে ইলা মিত্রের শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। ১৯৫৩-তে তাঁকে আনা হল ঢাকার সেন্ট্রাল জেলে। পরের বছরই তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আনা হয় চিকিৎসার কারণে। মেডিক্যাল টিম জানায়, তাঁর চিকিৎসা পূর্ব পাকিস্তানে হওয়া সম্ভব নয়। বিদেশের উন্নত পরিকাঠামোই একমাত্র সারিয়ে তুলতে পারে তাঁকে। সেইমতো বিদেশে চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি পান তিনি।
কলকাতায় এসে তিনি ভর্তি হন ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে। দীর্ঘ আটমাসের চিকিৎসায় সেরে ওঠেন তিনি। তবে, আর ফেরেননি পূর্ব পাকিস্তানে। সিটি কলেজে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন তিনি।
তবে এখানেই শেষ হয়নি তাঁর লড়াকু জীবন। পশ্চিমবঙ্গেও একাধিকবার জড়িয়েছেন আন্দোলনে। খেটেছেন জেলও। আজীবন কমিউনিস্ট এই নেত্রী লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। আজ, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষের এই যুগসন্ধিতে, ইতিহাস যেন তাঁকে ভুলে না যায়।