ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পীঠস্থান শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিবছর কয়েকশো ছাত্র পড়তে আসে এখানে। হ্যাঁ, শুধুমাত্র ছাত্র। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার অধিকার ছিল না মহিলাদের। কিন্তু, ১৯৪৭-এ হল ব্যতিক্রম। শিবপুরে প্রথম ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হলেন ইলা মজুমদার । আইন করে হয়তো খাতায়-কলমে শিক্ষার সমানাধিকার দেওয়া যায়। কিন্তু সমাজের চোখে নারী-পুরুষের ভেদ মোছাতে এগিয়ে আসতে হয় কোনো একজনকে। সুন্দর হয় না তাঁর রাস্তা, অনেক সংগ্রামের পথ পার করে পৌঁছোতে হয় লক্ষে। ইলা ঘোষ মজুমদার (Ila Ghose Majumdar) সেরকমই এক চরিত্র। বাংলার প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ার (First Woman Engineer) রূপে সুগম করে দিয়েছিলেন ভবিষ্যতের পথ।
পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরে ১৯৩০ সালে তাঁর জন্ম। পিতা যতীন্দ্রকুমার মজুমদার ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বাড়িতে ছিল মুক্তমনের অবাধ চর্চা। পড়াশোনার পাশাপাশি মোটর চালানোর মতো তথাকথিত পুরুষদের বিষয়েও অল্পবয়সেই পারদর্শী হয়ে ওঠেন তিনি। সাম্প্রদায়িক সমস্যায় পূর্ববঙ্গের পাঠ ওঠে মজুমদার পরিবারের। দেশভাগের আগেই মাত্র ১৬ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে ইলা চলে আসেন কলকাতায়। দু-বছর পরে পাশ করেন ম্যাট্রিক পরীক্ষা। ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পান ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু, তিনি ততদিনে স্বপ্ন দেখে ফেলেছেন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। যে সময়ের কথা হচ্ছে, তখন নারীর অধিকার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকত ঘর-সংসারের চৌহদ্দিতে। সেখানে কিনা বাঙালি ঘরের মেয়ে হবে ইঞ্জিনিয়ার? সে কাজ তো পুরুষদের একচেটিয়া!
১৯৪৭-এই অবশ্য শিক্ষার সর্বক্ষেত্রের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে পুরুষ-মহিলা উভয়ের জন্য। তৎকালীন বাংলার শিক্ষামন্ত্রী নিকুঞ্জ বেহারি মাইতির উদ্যোগে ছাত্রীদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজও। কার্যক্ষেত্রে ভর্তি হলেন শুধুমাত্র ইলা ও অজন্তা গুহ। যদিও দ্বিতীয় বর্ষেই বাদ পড়ে যান অজন্তা। ফলে কয়েকশো দেশি-বিদেশি ছাত্রের মধ্যে ইলা একা। এদিকে, ছাত্রীদের থাকার আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই, লাইব্রেরির পাশের একটা ছোটো ঘরই হল বাসস্থান। দেশভাগের পর পরিবারে নেমে আসে আর্থিক সংকটও। রাশ টানতে হয় রোজকার খাওয়া-দাওয়াতেও। ইচ্ছে ছিল সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার। কিন্তু ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজের অনুমতি দেয়নি কর্তৃপক্ষ, অগত্যা পড়তে হল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। যদিও সিভিল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক পুলিন বিহারি ঘোষ পরামর্শ ও তত্ত্বাবধানে অভিভাবকের মতো আগলে রেখেছিলেন ইলাকে। সহপাঠীরাও পার্থক্য বুঝতে দেয়নি কোনোদিন।
১৯৫১-তে শেষ হল স্নাতক স্তরের পড়াশোনা। দেশের প্রথম ‘মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে নাম উঠল ইতিহাসের পাতায়। এবার এক বছরের বাধ্যতামূলক শিক্ষানবিশের পালা। দেশে কি আদৌ কোনো সংস্থা ‘মহিলা’ শিক্ষানবিশ নিতে রাজি হবে? কলেজ কর্তৃপক্ষের এই সংশয়ের কারণে পাড়ি দিতে হল স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে। হাতে-কলমে কাজ শিখলেন ‘বার অ্যান্ড স্টাইড’ কোম্পানি থেকে। দেশে ফিরে যোগ দেন দেরাদুনের অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে। ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং ক্ষেত্রে কর্মরতা দেশের প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ারিং হিসেবে ছুঁলেন নতুন মাইলফলক। ছয় মাস কাজ করার পর ১৯৫৫-তে দিল্লির পলিটেকনিক কলেজে যোগদান অধ্যাপিকার পদে। বিয়ের পর যুক্ত হয় ‘ঘোষ’ পদবি, তারপরই স্থায়ীভাবে চলে আসেন কলকাতায়। যুক্ত হন ইনস্টিটিউট অফ জুট টেকনোলজি-তে। ১৯৬৩-তে তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলার প্রথম মহিলা পলিটেকনিক কলেজ। দায়িত্ব পালন করেন প্রথম অধ্যক্ষের। ১৯৬৭-তে আমেরিকার কেমব্রিজে মহিলা ইঞ্জিনিয়ার ও বিজ্ঞানীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি ছিলেন ভারতের প্রতিনিধি।
আরও পড়ুন
স্বাধীনতার আগেই বাংলায় গড়ে উঠেছিল যে-সমস্ত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ
১৯৮৫-তে ডাক আসে খোদ রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে। যেতে হবে ফেলে আসা মাতৃভূমি বাংলাদেশে। স্বাধীনতার পর মহিলাদের জন্য প্রথম পলিটেকনিক কলেজ প্রতিষ্ঠিত হবে ঢাকাতে। ইলা মজুমদার ছাড়া যোগ্য ব্যক্তি আর কে আছে এই কাজের জন্য? সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশের কাজ সমাপ্ত করেন তিনি। ২০১৯ সালে ৯০ বছর বয়সে প্রয়াণ ঘটে তাঁর। পেশাগতক্ষেত্রে সম্মুখীন হতে হয়েছিল লিঙ্গবৈষম্যের। কর্তৃপক্ষ নানা ছলে বাধ সেধেছে পদোন্নতিতে। লক্ষ্য করেছেন যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কখনই চায় না মহিলা কর্তৃত্ব। ফলে লড়াই শুধু কর্মক্ষেত্রেই আটকে থাকেনি, সমাজের এক বিষাক্ত রোগের সঙ্গেও ছিল যুদ্ধ। মাটি আঁকড়ে পড়েছিলেন, ধৈর্য নিয়ে প্রতিহত করেছিলেন সমস্ত বাধাবিপত্তি। সেদিন তিনি প্রথা ভাঙার সাহস দেখাতে পেরেছিলেন বলেই, মহিলা প্রযুক্তিক্ষেত্রে মসৃণ হয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের যাত্রা।
আরও পড়ুন
দেশের প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ভূগর্ভস্থ খনিতে আকাঙ্ক্ষা
Powered by Froala Editor