১৯৩১ সাল। ইংল্যান্ডের দুই বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় কেমব্রিজ আর অক্সফোর্ড মুখোমুখি ক্রিকেটের মাঠে। ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথের থেকে কোনো অংশে কম ছিল না দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের লড়াই। কেমব্রিজের হয়ে প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নামলেন অ্যালান র্যাটক্লিফ। করলেন ২০১ রান, সেই সময়ের বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেটে সর্বোচ্চ। বিপরীতে অক্সফোর্ডের টিমে ছিলেন এক ভারতীয় তরুণ। র্যাটক্লিফের জয়ধ্বনির মধ্যেই তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, সেই ম্যাচেই ভেঙে দেবেন রেকর্ড। দ্বিতীয় ইনিংসের দাপুটে ব্যাটিংয়ে অপরাজিত ২৩৮ রানে স্তব্ধ করে দিলেন ইংল্যান্ডের ক্রিকেট জনতাকে। কিন্তু কে এই তরুণ?
তাঁর নাম ইফতিখার আলি খান পতৌদি (Iftikhar Ali Khan Pataudi)। ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় মনসুর আলি খানের (Mansoor Ali Khan Pataudi) পিতা এবং পতৌদি বংশের অষ্টম নবাব। শুধু রাজকীয় পরিচয়ে নয়, ক্রিকেটের মাঠেও তিনি প্রমাণ রেখেছিলেন প্রতিভার। ভারত (India) ও ইংল্যান্ড (England) উভয় দলের হয়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলা একমাত্র খেলোয়াড়। ১৯১০ সালে জন্ম ইফতিখারের। মাত্র ষোলো বছর বয়সে উচ্চশিক্ষার জন্য চলে আসেন ইংল্যান্ডে। ক্রিকেট আর হকি দুটোতেই ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আর সেই সূত্রেই স্থান মেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দলে। ১৯৩১-এ অক্সফোর্ডের হয়ে ৯৩ গড়ে তিনি করেন মোট ১৩০৭ রান। একদিকে যখন তিনি ক্রিকেট মাঠে ফুল ফোটাচ্ছেন, তখনই ‘রাজা’ হিসেবে অভিষেক হয় তাঁর। পরের বছরেই ডাক পান ইংল্যান্ডের জাতীয় দলে।
১৯৩২-৩৩ সালের অ্যাসেজ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। যে অ্যাসেজ ‘কুখ্যাত’ হয়ে রয়েছে বডিলাইন (Bodyline) সিরিজের জন্য। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক তখন ডন ব্র্যাডম্যান আর ইংল্যান্ডের ডগলাস জার্ডিন। অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দের শরীর লক্ষ্য করে উড়ে আসতে থাকে একের পর এক বাউন্সার। ক্রিকেটীয় নিয়মে এই নিয়ে কোনো বিধিনিষেধ না থাকলেও, ‘ভদ্রলোক’-এর খেলায় সেই অ্যাসেজ ছিল এক কালো অধ্যায়। তবুও সিডনিতে প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া করে ৩৬০ রান। ইংল্যান্ড জবাব দেয় ৫২৪ রানের এক পাহাড়প্রমাণ ইনিংসের মাধ্যমে। সেই অভিষেক ম্যাচে শতরান করেন পতৌদি। তার ব্যাট থেকে আসে ১০২ রান। পরের ম্যাচে অবশ্য ভালো রান করতে পারেননি তিনি। এদিকে ক্রমশ দ্বন্দ্ব বাঁধতে থাকে জার্ডিনের সঙ্গে। অধিনায়কের নীতিতে সাফল্যে এলেও ‘বডিলাইন’-এর বিরোধী ছিলেন তিনি। এমনকি জার্ডিনের নির্দেশ অনুযায়ী লেগ সাইডে ফিল্ডিং করতেও অস্বীকার করেন। ব্যাস, পরের ম্যাচেই দল থেকে বাদ পড়লেন পতৌদি।
ফিরে গেলেন কাউন্টি ক্রিকেটে। যাকে বলা যায় ইংল্যান্ডের ক্রিকেটের প্রধান মেরুদণ্ড। উস্টারশায়ারের হয়ে ফিরে পেলেন নিজের পুরনো ফর্ম আর আত্মবিশ্বাস। যাবতীয় বিতর্ক সত্ত্বেও তাঁর ব্যাটকে অস্বীকার করতে পারল না ইংল্যান্ডের ক্রিকেট। ফের ডাক পেলেন জাতীয় দলে, কিন্তু মাত্র এক ম্যাচের জন্য। ১৯৩৪-এ মাত্র তিন ম্যাচে সমাপ্ত হয়ে গেল পতৌদির ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের কেরিয়ার। শুধুই কি ক্রিকেটীয় কারণ, নাকি অখেলোয়াড়সুলভ মনোভাবের বিরুদ্ধে এক পরাধীন নবাবের প্রতিবাদ অহংকারে আঘাত করেছিল শাসক ইংল্যান্ডের সত্তাকে? জার্ডিনের আচরণ ও কথাবার্তা কিন্তু ইঙ্গিত করে সেই দিকেই।
আরও পড়ুন
ব্যাট নিয়ে ধর্মান্ধদের সামনে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি ক্রিকেটারের প্রাণ বাঁচান সিকে নাইডু
অবশ্য তারপরেও চার বছর সমান দাপটের সঙ্গে কাউন্টি ক্রিকেটে রাজত্ব চালিয়েছিলেন তিনি। এরই মধ্যে ১৯৩৬ সালে এসে যায় এক আশ্চর্য সুযোগ। ইংল্যান্ডগামী ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নির্বাচন করা হয় তাঁকে। কিন্তু স্বাস্থ্যের কারণে সরে দাঁড়াতে হয় শেষ মুহূর্তে। পরের সুযোগ আসে দশ বছর পরে। তখন তাঁর বয়স ৩৬ বছর। ব্যাটেও নিয়মিত রান পাচ্ছেন না। ১৯৪৬-এ ‘ভারত’-এর অধিনায়কত্ব করার ডাক মেলে ফের। স্বাধীনতা তখন দোরগোড়ায়, দাঙ্গার আগুনে জ্বলছে দেশের দুই প্রান্ত। ‘ভারত’ নাম নিয়ে পার্সি-খ্রিস্টান-মুসলিম-হিন্দু ক্রিকেটারদের এক সঙ্গে খেলতে নামা এক অন্য বার্তা বহন করেছিল সেদিন। আবার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে লড়াই চলছে ইংল্যান্ডে। সেই সময় মুখোমুখি হয় দুই দল। কিন্তু তিন টেস্টের একটিতেও ভালো খেলতে পারেননি পতৌদি। করেছিলেন মাত্র ৫৫ রান। সমালোচনা হয় তাঁর অধিনায়কত্ব নিয়েও। অবশেষে চিরবিদায় জানান ক্রিকেটকে। যাঁর জীবন শুরু হয়েছিল ইংল্যান্ডের হয়ে, আর শেষ ম্যাচ খেললেন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন
ভারত-পাকিস্তান দুই দলের হয়ে খেলা তিন ক্রিকেটার
১৯৫২-তে অবশ্য উস্টারশায়ারের হয়ে ফের মাঠে নামার কথা ছিল। কিন্তু সে বছরই মৃত্যু ঘটে তাঁর। ঘটনাচক্রেও সেটাও খেলার মাঠেই। দিল্লিতে পোলো খেলার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। সেদিন ছিল ৫ জানুয়ারি, সন্তান মনসুর আলি খানের এগারোতম জন্মদিন। যিনি পরে ভারতীয় ক্রিকেটে শুরু করবেন নবযুগ। পিতার ঐতিহ্যকে পৌঁছে দেবেন সুউচ্চ আসনে।
Powered by Froala Editor