ক্যাব পাশ হয়ে গেল – সংসদের দুই কক্ষেই। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, ভারতীয় মুসলমানদের এতে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। তাঁরা সুরক্ষিত। তাঁকে ধন্যবাদ। তবু, আমরা ধরে নিলাম, আর-একজনও মুসলমান এ-দেশে থাকছেন না। আগামী কয়েক বছরেই সেই মহাযজ্ঞ সম্পন্ন হবে। বাইরে থেকে কেউ আসতে পারবেন না। ভিতর যাঁরা আছেন তাঁরা একবার এনারসি-র ছোবল খেলে, আর নাগরিকত্বের আবেদন জানাতে পারবেন না। অর্থাৎ অ-মুসলমান রাষ্ট্রের পথ সুগম। তাই, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাস সত্ত্বেও, ধরে নিচ্ছি, আর-একজন মুসলমান এ-দেশে থাকবেন না। মসজিদগুলো সব মন্দির হয়ে গেল। এমনকি, মুসলমানদের ঘরগুলোও একটা করে মন্দির হয়ে গেল। ধরা যাক গৈরিক পতাকা এ-দেশের পথে-প্রান্তরে উড্ডীন হল। তারপর... আমরা খুশি ও সুখী থাকব তো?
আমরা কারা? এ-প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়ার অর্থ আজ ভ্রাতৃহত্যা। এ-প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার অর্থ আজ নৈরাজ্য।
সেই সাধারণ অনামী ছেলেটি কি আমরা নয়? রাজনীতি নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। শুধু প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নেতাটি যখন বক্তৃতা দিতে উঠতেন, তার দু-চোখ চকচক করত। নেতাটির মুষ্টি আস্ফালনে সে-ও আস্তিন গুটিয়ে বলে উঠত, এই দেশের জন্য এটাই দরকার। সে কি ইতিহাস সচেতন? একদম নয়। সে কি মুসলিম বিরোধী? ততটাও নয়। যেমনটা এ-দেশের গড় ছেলেপুলেকে শেখানো হয়, এ-দেশের পাঠ্যপুস্তক মুসলিমদের প্রতি যতটা শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায় ততটা-ই। তার থেকে বেশি নয়। কারণ, তার সামগ্রিক বোধেই সে সব ছিল না। থাকার কথা নয়। কারণটা সে না জানুক, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জানিয়েছিলেন। গোপাল বড়ো ভালো ছেলে সকলেই জানে। কিন্তু কাশেম আদৌ কেমন ছিল সে সম্পর্কে তো একজন হিন্দু বালক কিছু জানে না। জানতে যে হয়, সেটাও তাকে জানানো হয় না। এমনকি, হিন্দু রাজাদের যে কিছু অগৌরবের কাহিনি থাকতে পারে, তা-ও তো তার ইতিহাস তাকে শেখায়নি। অথচ শিখিয়ে দিয়েছে মুসলমান শাসক কতখানি অত্যাচারী ছিল। এরমধ্যেই তার পাঠ্যপুস্তক জেনেছে যে, হিন্দু-মুসলমান এক বৃন্তে দুটি কুসুম। ভাই-ভাই। কী করে যে এই দুই ভাইকে মিলে থাকতে হবে, তার কোনও রূপরেখা তো তার কোনোদিনই জানা ছিল না। তবু থাকতে হয়, যেমনটা চলে আসছে। আমরা ছেলেটার কাছে ফিরলে দেখব, মুসলিম বিরোধিতা নিয়ে তার মাথাব্যথা ততটা ছিল না। যতটা স্বপ্ন তাকে দেখানো হয়েছিল একটা উন্নত, সমৃদ্ধতর দেশের। তার মনে হয়েছিল একজন বলিষ্ঠ নেতা প্রয়োজন। যেন এ-দেশ বলিষ্ঠ ছিল না। যেন এ দেশের সংবিধান ছিল দুর্বল! অধিভাষার সার্থকতম প্রয়োগ তার চোখে যে মায়াকাজল এঁকে দিয়েছিল, তাতে সে এই নেতাকে নির্বাচিত করতে দ্বিমত করেনি। ধরা যাক, কাল থেকে দেশে যদি আর-একজনও মুসলিম না-থাকে, সে-ও কি তবে খুশি হবে? সুখী হবে? জানা নেই। যদি হয় তো, কিছু বলার নেই। কিন্তু যদি না হয়, তবে এই পাপের দায় সে বইবে কেন? এর জবাব কি দিতে পারব আমরা?
এই আমরা কারা? আজ এই প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার অর্থ ইতিহাসের গ্রহণ লাগা অন্ধকার মুখে-চোখে মেখে নেওয়া।
সেই মহিলা কি এই ‘আমরা’ নয়? যিনি মনে করতেন, এই দেশে সকলেই বড়ো বেই স্বাধীনতা ভোগ করছেন। তিনি নিজে কি স্বাধীনতাকামী নন! অবশ্যই তা নয়। একজন স্বনির্ভর বলিষ্ঠ মহিলা হিসেবে তিনি নিজেকে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। কিন্তু এ-ও ঠিক যে, এই নাগরিক পরিসরে, সামান্যতম অগ্রসরের প্রতি পদে পদে তিনি দেখেছেন দলীয়তা, সংকীর্ণ স্বার্থের রাজনীতি কেমন ওঁৎ পেতে আছে সর্বত্র। সেই কলেজে ফর্ম তুলতে যাওয়া থেকে চাকরির প্রমোশন- এই দলের ধাক্কা খেতে খেতে একদিন তাঁর মনে হয়েছে, টোটালটেরিয়ান হোক তাও ভালো, তবু এই গণতন্ত্রের দরকার নেই। হায়! গোয়েবেলস বোধহয় অলক্ষে হেসেছিলেন। কারণ রসিকতা করে তিনি নাকি বলতেন, গণতন্ত্রের ভিতরেই এমন সব পরিসর আছে যা ধরে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দেওয়া যায়। এই ধ্বংসে সেই মহিলাও শামিল হলেন। হলেন ব্যক্তিগত স্বার্থ আর আক্রোশ চরিতার্থ করতে। কিন্তু তার মানেই কি তিনি মুসলিম বিরোধী? যদি হন, তবে কিছু বলার নেই। যদি না হোন, তবে আজ কি এই পাপের দায় নিতে রাজি হবেন তিনি?
কথা হল এই যে, সত্যিই হয়তো এ-দেশের এত বিপুল সংখ্যক মানুষ মুসলিম বিরোধী নন। হ্যাঁ, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিরোধের জায়গাগুলো যে আছে, তা ইতিহাসগতভাবে সত্য। সম্প্রীতির যত ছবি ভাগ করে নেওয়া, বিরোধের বিন্দুগুলোও যদি সেই হারে ভাগ করে নেওয়া যেত, তবে পুরোটা স্বচ্ছ হত। এই বিরাট কোহলি প্রজন্ম অন্তত এটুকু বুঝত যে, অতীতের দায় বয়ে বেড়ানোর দায় তার নয়। আবার সেই সঙ্গে এও স্বীকার্য যে এ-দেশের বহুসংখ্যক মানুষ মুসলিম বিরোধীও বটে। কিন্তু সত্যিই কি তা রুটি-রুজি-বাস্তু-ভিটের বিনিময়ে? অর্থাৎ, যে ক্যাব-এ যে-কোনো মানুষ বিপদে পড়তে পারে, সর্বস্বান্ত হতে পারে, তা স্বীকার করে নিয়েও একজন মুসলিমকে উচ্ছেদ করতে হবে, এমন পণ কি কেউ করে আছেন?
যে নমঃশূদ্রদের ঘোরতর মুসলিম বিদ্বেষী হিসেবে কতিপয় বিশিষ্টজন অভিধা দেন, তাঁদের জনে জনে গিয়ে প্রশ্ন করে আসুন। দেখুন, কে বলে যে নিজের ঘর-দোরের বিনিময়ে সে এই উচ্ছেদ-যজ্ঞে শামিল হবে? না, কেউই সায় দেবেন না। যে তরুণ গৈরিকমনা যুবক, কথায় কথায় মহামতি শংকর কি কুমারিল ভট্টের দেশ খুঁজে পেতে চান, তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন যে, তাঁর গুরুঠাকুর কি তাঁকে জানিয়েছেন যে, এ মহামতিরাও স্বীয় মতের প্রচার করতে অন্যের প্রাণনাশে কার্পণ্য করেননি! এমনকি মাথা কেটে ঢেঁকিতে কুটবার নিদানও দেওয়া ছিল। না, স্বভাবতই তাকে এসব জানানো হয়নি। জানানো হয়নি যে, ক্ষমতা বিশেষত রাজশক্তির হস্তক্ষেপেই হাওয়া ঘোরে। আর সে লড়াই গরিবে-গরিবে গৃহযুদ্ধের, তাদের বলিতে গিয়ে শেষ হয়। কি অতীতে, কি বর্তমানে এর ব্যত্যয় নেই। তাকে এসব তো জানানো হয়নি। ইতিহাসবিচ্ছিন্ন, মনিষাহীন যাপন আর স্মৃতির ভিতর অপরিসীম শূন্যতা তাকে ক্রমশ ঠেলে দিয়েছে বিদ্বেষ ও দোষারোপের পথে। আর সেই সমস্ত অজ্ঞতা কুড়িয়ে এনে জড়ো করে আজ যখন একটি সম্প্রদায়কে এ-দেশ থেকে উচ্ছেদের পথ তৈরি হচ্ছে, তখন তাকে কি জবাব দেব আমরা?
এই আমরা কারা? আজ এ-প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার অর্থ মনুষ্যেতর পদবাচ্য হওয়া।
এ-কথা ঠিক যে প্রশাসনিকতা – ফুকো কথিত সেই গভর্নমেন্টালিটির স্বরূপ আমাদের যা জানায়, তাতে ক্ষমতাতন্ত্রের প্রতিস্পর্ধী কোনও প্রকল্পের উদাহরণ সহজে দেখা যায় না। কিন্তু তবু মানুষের হাতে যা পড়ে থাকে, তা হল প্রতিরোধ। কিছুটা প্রত্যয় ও আশা। শেষ অবধি মানুষ সেটাই করতে পারে। সত্যিই বিকল্প কিছু গড়ে তোলা যায় কি না জানা নেই, কিন্তু চলমান অরাজকতাকে অন্তত চোখ রাঙানোর ক্ষমতা থাকে এই সাধারণ মানুষেরই। নাহ, সকলেই মুসলিম বিরোধী ছিলেন না। কিন্তু সকলেই এক ‘বলিষ্ঠ নেতার’ আফিম গিলেছিলেন সত্যি। আজ সেই মেজরিটির ভূত যা যা করিয়ে নিচ্ছে, তা করিয়ে নেওয়ার কথা ছিল না। এবং এ-সব হয়ে যাওয়ার পরও সেই মেজরিটি কোনও সুখে থাকবে না। ধরা যাক, কাল থেকে এ-দেশে আর-একজনও মুসলমানও থাকবেন না। তাহলেই কি এই পণ্যায়িত বিশ্বে শোষণ, এই মেগালোম্যানিয়া আর মিজাঁথ্রপি থেকে মুক্ত হয়ে অমরাবতীতে পৌঁছতে পারব আমরা? আমরা নিজেরাই জানি, তা সম্ভব নয়। মুসলমান থাকলেও নয়, না-থাকলেও নয়। তাহলে ঠিক কার কোন স্বপ্ন পূরণ করতে নিজেদেরকে মানুষের আসন থেকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছি আমরা?
এই আমরা কারা? আজ অন্তত যদি এই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাই, তাহলে আমরা সত্যি এবং সর্বার্থেই প্রথমত মুসলিম বিরোধী। দ্বিতীয়ত মুসলিম বিরোধী। এবং শেষ পর্যন্ত মুসলিম বিরোধী-ই।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
ছবি ঋণ - The national