লালমুখো ব্রিটিশের আদলে তৈরি দেবসেনাপতি! কাটোয়ার ঐতিহাসিক ‘সাহেব কার্তিক’-এর গল্প

কাটোয়ার পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন আপনি। জায়গায় জায়গায় কার্তিকপুজো। কার্তিকের লড়াই। হঠাৎ থমকে গেলেন একটি মূর্তি দেখে। ঠিক চেনা কাত্তিকঠাকুরটি নন তো! বরং কেমন যেন সাহেবের মতো দেখতে! আশেপাশের লোকজনদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, এঁর নাম ‘সাহেব কার্তিক’। অবাক হলেন খুব। হিন্দু ঠাকুরের অবয়ব তৈরি খ্রিস্টান সাহেবের চেহারায়! এ যে এক আশ্চর্য সম্প্রীতি! কোন গল্প লুকিয়ে এর পিছনে?

উঁকি দেওয়া যাক ইতিহাসের পাতায়। ১৮০৩ সাল। শ্রীরামপুরে হাজির রেভারেন্ড জন চেম্বারলিন। কিছুদিন সেখানে কাটানোর পর, ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ঘর বাঁধলেন কাটোয়াতে। শ্রীরামপুরের পর কাটোয়াকে বেছে নেওয়ার পেছনে যুক্তি ছিল কাটোয়ার ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক অবস্থান। গোটা বাংলাতে সহজেই যাতায়াত করার সুবিধা, নীল চাষের জন্য বিপুল জমি, কৃষিপণ্য ও বস্ত্র শিল্পের আধিক্যের জন্য কাটোয়াকে মিশনারিরা গুরুত্বপূর্ণ একটি অবস্থান হিসাবে দেখেছিলেন।

কাটোয়ায় প্রথমে দেবরাজ ঘাটের কাছে নবাবি সরাইখানায় থাকতেন চেম্বারলিন। তারপরই স্ত্রীকে নিয়ে ঘর বাঁধলেন আজকের সাহেববাগান অঞ্চলে। দু একর জায়গা, দুটো পুকুর এবং একটি আম বাগান কিনে ৪২×৩৫ ফুট মাপের একটা বাংলো বানালেন ৬৫০ টাকা খরচ করে। কিন্তু পাকাপাকিভাবে বসবাস করার সুখ তাঁর ভাগ্যে বেশিদিন ছিল না। সন্তান প্রসব করতে গিয়ে কাটোয়ার বাড়িতে মারা গেলেন জন চেম্বারলিনের স্ত্রী হানা চেম্বারলিন। বন্ধু মার্শম্যান এবং রেভারেন্ড চেম্বারলিন সাহেব হানাকে সাহেববাগানেই সমাধিস্থ করলেন(আজও নামহীন সেই সমাধিগুলির মধ্যে তার সমাধিটি দেখতে পাওয়া যায়)। এইসময়ই জন চেম্বারলিনকে সাহায্য করতে কাটোয়ায় হাজির হন ড. উইলিয়াম কেরি সুযোগ্য পুত্র কেরি দ্যা জুনিয়র। প্রায় চল্লিশ বছরের বেশি সময় তিনি কাটোয়া শহরে কাটিয়েছিলেন এবং তার সমাধি আজও দেখতে পাওয়া  যায় সাহেববাগানের কাশেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের পাশে। 

কেরি দ্যা জুনিয়রের জন্ম ইংল্যান্ডের মোলটোন শহরে ২২ শে জুন ১৮৮৭ সালে। বাবা  ড. উইলিয়ম কেরি। মা ডরোথি প্লাকেট। কেরি দম্পতির সাত সন্তান- আনা, ফেলিক্স, জুনিয়ার কেরি, পিটার, লুসি, জ্যাবেজ ও জোনাথন। ১৮০০ সালের পর থেকেই কেরির জীবনে খ্রিস্টধর্মের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়তে শুরু করে, বিশেষ করে শ্রীরামপুরে আসার পর থেকে। ওয়ার্ড সাহেবের ছাপাখানার কাজে অংশগ্রহণ করার পর থেকে ওয়ার্ড সাহেবই হয়ে ওঠেন তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু। মনের মধ্যে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, বিশ্বাস-অবিশ্বাস এবং নানা প্রশ্ন জাগ্রত হয়। শুরু হয় সাধকের আধ্যাত্মিক সংকট। এই মানসিক সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে সহায়তা করেন বাবা ড. কেরির সব বিখ্যাত বন্ধুরা। এঁদের মধ্যে দু’জন ব্যক্তি ছিলেন জুনিয়ার কেরির অতি কাছের মানুষ। মিস্টার টমাস ও আন্ড্রেয় ফুলার সাহেব। দু’জনেই কেরিকে চিঠি লিখে তাঁর আধ্যাত্মিক জীবনে উৎসাহ সঞ্চার করেছিলেন। ১৮০৩ সালের এপ্রিল মাসে বাবার কাছেই খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে কেরি দ্যা জুনিয়র মিশনারি জীবন শুরু করেন।

আরও পড়ুন
ভূতচতুর্দশীতে আজও তৈরি হয় পেত্নীর মূর্তি; ঐতিহ্যের আড়ালে প্রেতচর্চার ইতিহাস?

১৮১১ সালে রেভারেন্ড জন চেম্বারলিনকে আগ্রায় বদলি করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই বছরই কাটোয়া মিশনারি স্টেশনের দায়িত্ব পান কেরি দ্য জুনিয়র। কাটোয়ার আশপাশে ধর্মপ্রচার থেকে শুরু করে ক্রমশ দধিয়া বৈরাগ্যতলার মেলা, কেঁদুলির মেলা এবং অগ্রদ্বীপের গোপীনাথের মেলাতেও তিনি বাংলা ভাষায় যিশুর কথা শোনাতেন সাধারণ মানুষকে। গ্রামে গ্রামে, মেলায় মেলায় মানুষকে বিনামূল্যে শ্রীরামপুর প্রেসের ছাপা খ্রিস্টধর্মীয় পুস্তক বিলি করতেন। কাটোয়া মিশনারি স্টেশনের উন্নতির লক্ষ্যে নীলচাষ ও বস্ত্রশিল্পের ব্যবসাও শুরু করেন। এমনকি তিনি চিনি, রেশমের ব্যবসার পাশাপাশি কাটোয়ার সাহেব বাগান অঞ্চলে পরীক্ষামূলকভাবে কফিচাষও শুরু করেছিলেন। তবে ধর্মপ্রচার বা ব্যবসাতেই তিনি থেমে থাকলেন না, শুরু করলেন মানবপ্রেমীর মতো মানুষের পাশে দাঁড়াবার কাজটিও। কাটোয়ায় সতীদাহ, কুষ্ঠরুগী পুড়িয়ে মারা অথবা গঙ্গায় প্রথম সন্তান বিসর্জনের মতো কুপ্রথার বিরুদ্ধেও তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলন। গঙ্গায় অন্তর্জলির উদ্দেশে ফেলে রেখে যাওয়া একাধিক বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাকে তিনি গঙ্গার তীর থেকে তুলে এনে সেবা-শুশ্রুষা করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কাটোয়ার উন্নতির জন্য মাসিক ৪০ টাকা খরচ করে একটি হাসপাতালও খোলেন তিনি। শুরু করেছিলেন মেয়েদের জন্য বালিকা বিদ্যালয়ও। ১৮৩২ সালের ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কাটোয়া বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী সংখ্যা ছিল প্রায় ২০০ জন। কেরি দ্যা জুনিয়র সাহেব বালিকা বিদ্যালয় ছাড়াও কাটোয়ার আশপাশে বিভিন্ন গ্রামে অনেকগুলি  বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেন, যেমন দাঁইহাট, কাথাটি, কড়াই, চরপুনি, বাঁদরা, কুলিগ্রাম ইত্যাদি স্থানে। দীর্ঘদিন আত্মীয় পরিজন ত্যাগ করে কাটোয়ার থাকার জন্য মাঝেমধ্যে তিনি কলকাতায় যেতেন নিজের পরিবারের কাছে। ১৮৫২  খ্রিস্টাব্দে আত্মীয়দের  কাছে একবার কলকাতা গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অসুস্থ অবস্থাতেই কাটোয়া ফিরে আসেন, কিন্তু শরীর তার আর সাথ দিল না। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৩রা ফেব্রুয়ারি রাত ১০টায় কাটোয়ার বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কেরি দ্যা জুনিয়র। সেদিন অগণিত কাটোয়ার মানুষ জড়ো হয়েছিল মানবহিতৈষী কেরি সাহেবকে একবার শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। 

আরও পড়ুন
বাবুদের আমলে, ‘ন্যাংটো কার্তিক’-এর পূজা শুরু হয় কাটোয়ার বেশ্যাপল্লিতে

কাটোয়ার সাহেব বাগানের মানুষ তথা কাটোয়ার মানুষ তাকে ভুলে যাননি। ফি বছর সাহেব কার্তিক পূজার মাধ্যমে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। কিন্তু প্রশাসনের উদ্যোগে আজও তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কোনো রাস্তা অথবা পার্কের নাম তাঁর নামে রাখা হয়নি, এ বড়ো লজ্জার!। স্মৃতি বলতে শুধু পুকুর পাড়ের  সমাধিতে জ্বলজ্বল করছেন সাহেব কেরি দ্যা জুনিয়র। আর বচ্ছরকার এই পুজো। ব্যস, আর কিচ্ছু নয়...

Powered by Froala Editor

More From Author See More