গান গেয়ে প্রথম উপার্জন ২৫ পয়সা, সব ছেড়ে চাষবাস করার কথাও ভেবেছেন উদিত নারায়ণ

বিহারের সুপাউল জেলার বৈশী গ্রামে সেদিন বেশ উত্তেজনা। জলসা হবে যে! গানবাজনা, নাচ— সে এক এলাহি ব্যাপার। সমস্ত আয়োজন সাড়া; গ্রামের লোকেরাও সবাই কাজ টাজ সেরে অপেক্ষা করছেন। এমন সময় হাজির হল গ্রামেরই এক কিশোর। সেও গান গাইবে জলসায়। ছোটো থেকে মহম্মদ রফির গান শুনে এসেছেন রেডিওতে। রফি সাবই ছিলেন কিশোরের গুরু। এ যেন নতুন যুগের দ্রোণাচার্য-একলব্য! যাই হোক, জলসায় হাজির হল সেই কিশোর। তার গানে সবাই খুশি। আহা, কি সুন্দর গলা! সেই গলার জন্যই বিহারের গ্রামের সেই কিশোর উদিত নারায়ণ পেলেন পুরস্কার— ২৫ পয়সা! গান গেয়ে জীবনে প্রথম উপার্জন…

‘কণ্ঠস্বর হয়তো ভগবানের দান’; কিন্তু জীবন তো সতত সুখের নয়। আজ উদিত নারায়ণ বললেই আমাদের সামনে ভেসে আসে নব্বইয়ের দশকের একের পর এক গান। বলিউডের অন্যতম বিখ্যাত গায়ক, ‘এভারগ্রিন’ বললেও কি কম বলা হয়! উদিত নারায়ণের গলা কত তরুণ-তরুণীর প্রেমের সাক্ষী হয়ে থেকে গেছে। আর স্বয়ং গায়কের জীবন? সেখানে হাজির হয়েছে নানা বাঁক। কখনও উঠেছেন, কখনও আবার কালো মেঘে ছেয়ে গেছে সংসার… 

বাবা হরেকৃষ্ণ ঝা ছিলেন নেপালের অধিবাসী। পরবর্তীকালে অবশ্য বিহারে চলে এসেছিলেন। বিহার না নেপাল - কোথায় জন্মেছিলেন উদিত নারায়ণ, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ২০০৯ সালে যখন পদ্মশ্রী পান, তখন থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত। অবশ্য উদিত সারাজীবনই নিজেকে বিহারের ভূমিপুত্র বলে এসেছেন। মামাবাড়িতেই বড়ো হচ্ছিলেন তিনি। সংসারের অবস্থা তো সেরকম নয়। একজন সাধারণ কৃষক কতই বা উপার্জন করেন! কিন্তু ছেলে উদিতের চোখে ছিল স্বপ্ন। পড়াশোনার হাত ধরে এগোচ্ছিলেন তো বটেই; সেই সঙ্গে ছিল তাঁর গলা। ছিল গান… 

সংসার সামলে লোকসঙ্গীতের চর্চা করতেন মা ভুবনেশ্বরী দেবী। বলা ভালো, নেপালী আর মৈথিলী লোকসঙ্গীত শুনে শুনেই বেড়ে উঠেছিলেন উদিত নারায়ণ। মায়ের কাছেই প্রথম শিক্ষা। আর ছিল একটি রেডিও। তাও নিজের নয়, প্রতিবেশীর। সেখানে গান বাজলেই মন দিয়ে শুনতেন ছোট্ট উদিত। সেই সূত্রেই খুঁজে পাওয়া মহম্মদ রফিকে। ওই দরদভরা গলা, ওই গান কী করে ভুলবেন তিনি? সেখান থেকে একটু একটু করে শিখতে চেষ্টা করা। পরবর্তীতে নেপালে যখন পড়তে গেলেন, সেখানেও হাজির হল রেডিও। এবার আর শ্রোতা হিসেবে নয়, সরাসরি গায়ক হিসেবে। তখনও উদিত নারায়ণ ছিলেন একজন লোকসঙ্গীত শিল্পী। নেপালি, মৈথিলী দুটি ভাষাতেই চলত গান। 

আর হিন্দি? তখনও এই ভাষার প্রবেশ ঘটেনি উদিত নারায়ণের জীবনে। ঠিক মতো হিন্দি বলতেই পারতেন না! অবাক কাণ্ড, সেই হিন্দি সিনেমার জগতেই চিরস্থায়ী আসন লাভ করলেন। সেও এক আশ্চর্য গল্প। মুম্বইতে শত শত ভাগ্যান্বেষী তরুণের ভিড়ে হাজির হলেন উদিত নারায়ণ। পকেট শূন্য; কিন্তু চোখে স্বপ্ন, গলায় গান। ইচ্ছা, বলিউডের ময়দানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। কিন্তু একবর্ণও হিন্দি বলতে পারেন না। অবশ্য সেজন্য থেমে ছিলেন না উদিত নারায়ণ। ১৯৮০ সাল। ‘উনিশ-বিশ’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে রাজেশ রোশন। সেখানেই সুযোগ পেলেন তরুণ উদিত। আর স্টুডিওতে গিয়েই দেখলেন, দাঁড়িয়ে আছেন ঊষা মঙ্গেশকর। আর সঙ্গে? উদিত নারায়ণের মুখ থেকে কথা সরছে না। আরেকজন যে স্বয়ং মহম্মদ রফি! তাঁদের সঙ্গেই কিনা বলিউডে প্রথম গানটি গাইলেন তিনি! 

অবশ্য এরপর লতা মঙ্গেশকর, কিশোর কুমারের সঙ্গেও গান করেন তিনি। সবই ঠিক আছে, কিন্তু সিনেমা বেশি চলল না। এমনকি গানগুলোও সেভাবে পরিচিতি পেল না। তাহলে কি এভাবেই হারিয়ে যেতে হবে? এমন পরিস্থিতিতেই ১৯৮৮ সালে মনসুর খানের পরিচালনায় মুক্তি পেল ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’। নবাগত অভিনেতা আমির খানের প্রথম সিনেমায় দুটি গান গাইলেন। ‘অ্যায় মেরে হামসফর’, আর ‘পাপা কহেতে হ্যায় বঢ়া নাম করেগা’। দ্বিতীয় গানটি শুরুতে সেরকম হিট করল না। আরও মুষড়ে পড়লেন উদিত নারায়ণ। ঠিক করলেন, এবার যদি কিছু না হয় তাহলে ফিরে যাবেন বিহারের গ্রামে। শুরু করবেন চাষবাস। 

আরও পড়ুন
কোপেনহেগেনে সেরার সেরা ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার’, বাংলা গানেই হৃদয় জিতলেন রুমা

তখন সিনেমাটি তৃতীয় সপ্তাহে পড়েছে। হঠাৎ করেই যাবতীয় ছবিটা বদলে গেল। উদিত নারায়ণের গাওয়া দুটি গান সাদরে গ্রহণ করল ভারত। না, আর বলিউড ছেড়ে চাষের কাজে যেতে হয়নি তাঁকে। বলা ভালো, ১৯৮৮ থেকেই শুরু উদিত নারায়ণের জয়যাত্রা। নব্বইয়ের দশক, একবিংশ শতকের প্রথম দশক— উদিতের জাদু গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল। কোন গানটি লিস্ট থেকে বাদ দেবেন আপনি? ‘প্যাহেলা নশা’ থেকে ‘ফলক তক চল সাথ মেরে’— দীর্ঘ বহু বছর ধরে আমাদের সঙ্গী এই গানগুলি। সঙ্গী উদিত নারায়ণ।   

তার মধ্যেই ঝড় এসেছে দাম্পত্য জীবনে। দীপা গহতরাজের সঙ্গে প্রেম, তারপর ১৯৮৫ সালে তাঁদের বিয়ে। হঠাৎই ২০০৬ সালে সামনে আসে চাঞ্চল্যকর একটি খবর। দীপাকে বিয়ে করার আগেই বিহারে আরও একটি বিয়ে করেছিলেন উদিত নারায়ণ। সামনে আসে সেই স্ত্রীর নামও। বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন উদিত নারায়ণ। শেষ পর্যন্ত অবস্থার মিটমাট হয়ে গেলেও, খানিক ভাটা পড়ে কেরিয়ারে। অবশ্য উদিত নারায়ণকে কি এই গণ্ডিতে আটকে রাখা যায়? তাঁর সমস্ত গান তো অমরত্ব পেয়ে গেছে ততদিনে। বিবিসি’র নির্বাচিত সেরা বলিউড গানের তালিকায় তাঁর সগৌরব উপস্থিতি। পেয়েছেন পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ সম্মান-সহ আরও বহু সম্মান। আর আমরা? একটু একটু করে খুঁজে নিই উদিত নারায়ণের গানগুলো। তারপর ডুবে যাই সেখানে। ওঁদের ছেড়ে কি যাওয়া যায়, এত সহজে!   

তথ্যসূত্র-
১) ‘প্রথম স্ত্রীকে না জানিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে, উদিত নারায়ণের দুই স্ত্রী এখন একসঙ্গে শপিংয়ে যান’, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘হিন্দি না জেনেও পাঁচটি ফিল্মফেয়ার, এটাই উদিত নারায়ণ’, সংবাদ প্রতিদিন
৩) ‘১০০ রুপিতে সারা সন্ধ্যা গাইতেন উদিত’, প্রথম আলো 

আরও পড়ুন
গণনাট্য সংঘে আত্মপ্রকাশ সুরকার সলিল চৌধুরীর, সেখানেই নিষিদ্ধ হল তাঁর গান

Powered by Froala Editor

More From Author See More