জিনসের (Jeans) প্যান্ট পরে না, এমন মানুষের সংখ্যা আজ কমে আসছে দ্রুত। বিশ্বায়নের দৌলতে ডেনিম স্টাইল স্টেটমেন্টে পরিণত হয়েছে বহুদিন আগেই। পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে তার চাহিদা, উৎপাদন, দাম। অথচ, অধিকাংশ ডেনিম ব্যবহারকারীই অজান্তেই এই ফ্যাশন-বিপ্লব কণ্ঠরোধ করে চলেছে প্রকৃতির (Environment)। হয়ে উঠেছে বাস্তুতন্ত্রের মৃত্যুর কারণ।
হ্যাঁ, এমনটাই জানাচ্ছেন গবেষকরা। সম্প্রতি প্যারিসের এক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে আয়োজিত হয়েছিল একটি বিশেষ প্রদর্শনী। ‘জিনস’-খ্যাত এই প্রদর্শনীদের দেখানো হয়েছে বিশ্বজুড়ে প্রতি সেকেন্ডে বিক্রি হয় ৭০টিরও বেশি জিনসজাত পণ্য। বাৎসরিক হিসাবে সংখ্যাটা দাঁড়ায় প্রায় ২২০ কোটি। জিনসের এই বিপুল পণ্য উৎপাদন কীভাবে প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে প্রতিমুহূর্তে তা-ই তুলে ধরেছিল প্যারিসের প্রদর্শনীটি।
তবে এই প্রদর্শনীর বহু আগে থেকেই জিনসের প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করেছিলেন গবেষকরা। হয়েছিল একাধিক সমীক্ষা। সেখানে উঠে এসেছিল একটি জিনসের প্যান্ট তৈরির জন্য যে পরিমাণ কাপড়ের প্রয়োজন হয়, তা তৈরি করতে খরচ হয় ২৬০০-৫২০০ গ্যালন জল। অর্থাৎ, প্রায় ১০-২০ হাজার লিটার। হ্যাঁ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই বিপুল পরিমাণ জল সরবরাহিত করা হয় নদী বা হ্রদ থেকে। কোথাও আবার ব্যবহৃত হয় ভূগর্ভস্থ জল। কারণ, জিনস তৈরি ও পরিশোধনের জন্য প্রয়োজন পড়ে মিষ্টি জলের। ফলে জিনস উৎপাদনের কারণে যে জলসংকট প্রকট হচ্ছে দিনে দিনে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো।
এই ঘটনার অন্যতম উদাহরণ হল আরল সাগর। বর্তমান উজবেকিস্তান তথা সাবেক সোভিয়েত অঙ্গরাজ্যটিতে অবস্থিত এই হ্রদকে কেন্দ্র করেই পঞ্চাশের দশকে গড়ে উঠেছিল প্রকাণ্ড সব জিনস কারখানা। সেইসঙ্গে আরল সাগরের চারপাশে শুরু হয়েছিল কার্পাসের উৎপাদন। বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপারটা লাভজনক হলেও, শেষ পর্যন্ত আরল সাগরের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় জিনস শিল্প। প্রথমত, কার্পাস উৎপাদনের জন্যও প্রয়োজন হয় প্রচুর পরিমাণ জলের। যে-অঞ্চলে কার্পাস চাষ হয়, তা শুকিয়ে যায় দ্রুত। ফুরিয়ে আসে ভূগর্ভস্থ জলের ভাণ্ডার। আরলের ক্ষেত্রেও হয়েছিল এই একই ঘটনা। পাশাপাশ জিনস তৈরির জন্যও আরল সাগর থেকে সংগ্রহ করা হত প্রচুর পরিমাণ জল।
এখানেই শেষ নয়, জিনস তৈরি ও পরিশোধনের পর রং, অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ, কীটনাশক মিশ্রিত জলও নিষ্কাশিত করা হত আরল সাগরে। ফলে, ক্রমেই দূষিত হয়ে ওঠে সাগরের জল। হারিয়ে যায় প্রায় ২৪টি প্রজাতির মাছ। উপার্জন হারান হাজার হাজার মৎস্যজীবী। পাশাপাশি স্যাটেলাইট ছবির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ১৯৫০-২০২০— এই সত্তর বছরের মধ্যে ৯০ শতাংশ জল শুকিয়ে গেছে আরল সাগরের। অন্যদিকে হ্রদের নিচে জমে থেকে রাসায়নিক আজ বালি ও হাওয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশের অঞ্চলে। হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য রোগের কারণ। একই ঘটনা ঘটে চলেছে ব্রাজিলের মাতো গ্রসো নদী তীরবর্তী অঞ্চলে। সেখানেও তুলা চাষের কারণে ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে বিঘার পর বিঘা সাভানা।
এখানেই শেষ নয়। জিনস উৎপাদনের সময় উচ্চমাত্রায় নির্গত হয় গ্রিনহাউস গ্যাস। অপব্যয় হয় শক্তির। পাশাপাশি ব্যবহারকারীরা যখন জিনসের প্যান্ট কাচেন, তখনও মাইক্রোফাইবার ও রাসায়নিক ছড়িয়ে দূষণ ঘটায় প্রকৃতিতে।
বছর কয়েক আগে জিনসের এই ক্ষতিকর প্রভাবগুলি নিয়ে একাধিক গবেষণা প্রকাশিত হওয়ার পর ‘গ্রিন জিনস’ বা পরিবেশবান্ধব জিনস তৈরির কথা ঘোষণা করেছিল বেশ কিছু বৈশ্বিক জিনস উৎপাদনকারী সংস্থা। তবে সেই জিনসের দাম সাধারণ জিনসের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। ফলে, তার উৎপাদন এবং চাহিদা দুই-ই কম। এই উদ্যোগের এক দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরেও বিন্দুমাত্র বদলায়নি পরিস্থিতি। বরং, আরও ত্বরান্বিত হয়েছে জিনস-সংক্রান্ত দূষণ। তবে উপায়?
না, একদিনে জিনসের ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব নয় মানব সভ্যতার পক্ষে। গবেষকরা জানাচ্ছেন, জিনসের পোশাক ধোয়ার হার কমলে, খানিকটা হলেও কম হতে পারে এই দূষণের প্রভাব। তাছাড়া অযথা নতুন জিনস না কিনে, দীর্ঘদিন ধরে জিনস ব্যবহার করলেও কমবে চাহিদা ও উৎপাদন। একইসঙ্গে কমবে দূষণের পরিমাণও। দূষণ নিয়ন্ত্রণে সেটাই প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত মানব সভ্যতার।
Powered by Froala Editor