জ্যান্ত মানুষের সঙ্গেই বসবাস করে ইতালির মমিরা!

মমির প্রসঙ্গ উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মিশরের ছবি। তাছাড়াও চিলি, কলোম্বিয়া বা ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জেও মমির সন্ধান মিলেছে, সে-কথা অনেকেরই জানা। কিন্তু কেউ যদি মমি দেখার জন্য ইতালি ভ্রমণের প্রস্তাব দেয়?

হ্যাঁ, ইতালিতে মমি! অবাক লাগছে নিশ্চয়ই? ইতালির (Italy) ফ্রিউলি-ভেনিজিয়া গিউলিয়ার উডিন প্রদেশে গেলে বদলে যাবে এই ধারণা। চমকের এখানেই শেষ নয়। ইতালির এই মমিদের বিশেষত্ব হল, তারা বসবাস করে মানুষের সঙ্গেই। এমনকি মমিরা (Mummies) কখনও কখনও হয়ে ওঠে চা-পান কিংবা খেলার সঙ্গী।

খুলেই বলা যাক এই ঘটনাটা। ইতালির ভেনজোনে শহর। ১৬৪৭ সাল। সেখানকার অন্যতম গির্জা সান মাইকেল চ্যাপেলের পুনর্নির্মাণ চলছে তখন। সেইসময়ই গির্জার বেসমেন্ট থেকে উদ্ধার হয়েছিল প্রায় ৪২টি মৃতদেহ। বা, বলা ভালো ৪২টি মমি। অবশ্য মমি কথাটি তখনও ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়েনি। আর কাপড় নয়, বরং পাতলা শুকনো পার্চমেন্ট কাগজের আস্তরণে মোড়া ছিল এই মমির দেহ। 

স্বাভাবিকভাবেই মমির ধারণা না থাকায়, গির্জার সন্ত ও ভক্তদের বিশ্বাস ছিল, স্বয়ং ঈশ্বরই হয়তো তাঁদের পূর্বপুরুষদের এভাবে পাঠিয়েছেন তাঁদের কাছে। সেখান থেকেই শুরু হয় মমিদের সঙ্গে মানুষের বসবাস। একটা সময় গির্জার অভিভাবকও হয়ে উঠেছিল এই মমিরা। গ্রাম ছাড়ার আগে বহু মানুষ আশীর্বাদও নিয়ে যেতেন মমিদের থেকে। মমি-মানুষের এই অদ্ভুত সম্পর্ক স্থায়ী ছিল ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত। হয়ে উঠেছিল ভেনজোনের ঐতিহ্য। 

আরও পড়ুন
মিশর নয়, পৃথিবীর প্রাচীনতম মমিদের বাসস্থান চিলি

তবে যেমন আকস্মিকভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল এই মমিগুলি, ঠিক সেভাবেই হারিয়ে যায় তাদের একাংশ। ১৯৭৬ সালে ইতালির এই প্রদেশ শিকার হয় ভয়াবহ ভূমিকম্পের। প্রায় ১৫ মিনিট ধরে স্থায়ী হওয়া এই ভূমিকম্পে ধ্বসে পড়েছিল সান মাইকেল চ্যাপেলের একাংশ। যার মধ্যে ছিল বেসমেন্টও। সে-সময়ই ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে চিরকালের মতো হারিয়ে যায় বেশ কয়েকটি মমি। বর্তমানে অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র ১৫-১৬টি মমি।

আরও পড়ুন
মমির বাক্সে বন্দি ভারতের সংবিধান!

কিন্তু ধ্বংসস্তূপ সরিয়েও কী হদিশ পাওয়া যায়নি হারিয়ে যাওয়া মমিগুলির? আর কারাই বা এই মমি তৈরি করেছিল? এখনও রহস্যের মেঘ ঘিরে রয়েছে উভয় বিষয়কেই। রয়েছে একাধিক তত্ত্বও। যার মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ও যুক্তিযুক্ত হিসাবে মনে করা হয় মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আর্থার আউফডারহাইডের তত্ত্বকে। 

আরও পড়ুন
মিশরীয় সভ্যতারও ২০০০ বছর আগে মমি! কারা বানাতেন সেসব?

১৯৮০-র দশকে বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তিনি নির্ধারণ করেছিলেন মৃতদেহগুলির বয়স। উঠে আসে, মমিগুলি আদতে তৈরি হয়েছিল চতুর্দশ শতকে। কিন্তু গির্জার মধ্যে কেন রাখা হল সেগুলিকে? আর্থার অনুমান করেছিলেন, এই সকল ব্যক্তিরা মারা গিয়েছিলেনস ব্ল্যাক ডেথ মহামারীতে। সেসময় দাবানলের মতোই ইতালিতে ছড়িয়েছিল ব্ল্যাক ডেথ। উপচে উঠেছিল দেশের সমস্ত সমাধিক্ষেত্রই। তাই বাধ্য হয়ে গির্জার বেসমেন্টেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল এই ব্যক্তিগুলিকে। আর মমিকরণের কারণ?

না, আদতে মমি করে সংরক্ষণ করা হয়নি মৃতদেহগুলিকে। সেগুলি সাধারণভাবেই কাঠের কফিনে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। তবে ‘হাইফা টমবিসিনা’ নামের এক ছত্রাকের প্রভাবে দ্রুত শুকিয়ে ওঠে মৃতদেহগুলি। এই বিশেষ গোত্রের ছত্রাকের অত্যাধিক জলশোষণ ক্ষমতাই জন্ম দেয় মমির। মমির গায়ে যা পার্চমেন্ট কাগজের আস্তরণ বলে মনে হয়, তা আদতে মৃত ব্যক্তিদের শুকিয়ে যাওয়া ত্বক। যদিও এই তত্ত্ব সঠিকভাবে প্রমাণিত হয়নি আজও। অন্যদিকে অবশিষ্ট থাকা গুটিকয় মমির দেহে পরীক্ষানিরীক্ষা চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইতালির প্রশাসন। সবমিলিয়ে ইতালীয় মমির রহস্য রয়ে গেছে সেই তিমিরেই…

Powered by Froala Editor

Latest News See More