এক বছর আগের কথা। কোভিড-১৯ মহামারী হঠাৎ করেই যেন ঘেঁটে দিয়েছিল আমাদের নিয়মিত জীবনকে। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল স্কুল-কলেজ, কর্মসংস্থান। সেইসঙ্গে মৃত্যুমিছিল। তবে এর পাশাপাশি অন্যদিকে সারাদিন গৃহবন্দি থাকাও যেন অঢেল সময় এনে দিয়েছিল মানুষের হাতে। সেই সময়টাকে কাজে লাগিয়েই অনেকে নতুন করে খুঁজেছেন নিজেদেরকে। আবিষ্কার করেছেন হারিয়ে ফেলা শখ কিংবা প্রতিভাকে। এমনই একটি উদাহরণ শুনলে স্তম্ভিত হয়ে যেতেই হবে। সেইসঙ্গে এই করোনাকালেও নিশ্চয়ই মনে জাগবে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ার ইচ্ছে।
ডমোনকোস বসজে এবং অ্যানা বসজে— হ্যাঙ্গেরির এই দম্পতি লকডাউনের সুযোগে পাড়ি জমিয়েছেন সমুদ্রপথে। সঙ্গে দুই কন্যা সন্তান— বয়স যথাক্রমে ৬ ও ৮ বছর। না, কোনো ছোটো খাটো ঘুরতে যাওয়া নয়। একেবারে সমুদ্রপথে বিশ্বভ্রমণ। আর এই অভিযানে ছোট্ট পরিবারটির সম্বল ৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি মোটরচালিত নৌকা।
খাওয়া-দাওয়া, থাকা সব সেই নৌকাতেই। খানিকটা হাউসবোটের মতো করেই তাঁরা ব্যবহার করছেন এই জলযানকে। তবে ছোট্ট এই বোটে চারজনের জায়গা হতে প্রথমে যে অসুবিধা হয়নি, তা নয়। তবে যত দিন গেছে, অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তাঁরা। কোথাও দাঁড়ালে মাস খানেকের জন্য খাবার মজুত করে নেওয়া নৌকোয়। আর তাছাড়া মৎস্যশিকার তো রয়েছেই। সমুদ্রপথে টুনা শিকার যেন আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছে এই অভিযানের মেজাজকে। স্বামী-স্ত্রী পালা করেই চালাচ্ছেন এই বোট। রান্না হোক কিংবা মাঝপথে নৌকা খারাপ হয়ে গেলে সারানোর কাজ— সবই নিজহাতেই করছেন বসজে দম্পতি।
গত এপ্রিলে হাঙ্গেরি থেকে যাত্রা শুরু করে ২০২০-র শেষের দিকে ক্রোয়েশিয়ায় পৌঁছন তাঁরা। তারপর ইতালি ও স্পেনের সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে ভ্রমণ করেছে এই পরিবার। মার্টিনিকে ক্রিসমাস কাটিয়ে এখন তাঁদের অবস্থান ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের সেন্ট মার্টিনের মেরিগোটে। সেখানে মাস খানেক কাটিয়ে পানামার দিকে পাড়ি দেবেন তাঁরা।
কিন্তু এমন একটা দুঃসাহসিক যাত্রার জন্য দরকার বিপুল পরিমাণে অর্থ। কোথা থেকে আসছে সেসব? ডমোনকোস জানাচ্ছেন, নৌকার মধ্যেই অফিস চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আইটি সেক্টরে কাজ করায় বর্তমানে চলছে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। তবে একে ‘ওয়ার্ক ফ্রম বোট’ বলাই বোধ হয় শ্রেয়। আর সন্তানদের পড়াশোনা? তারও ব্যবস্থা করে ফেলেছেন বসজে দম্পতি। কোথাও মাস খানেকের জন্য নোঙর ফেললে সেই অঞ্চলের ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করে ফেলছেন দুই সন্তানকে। অনলাইনেই চলছে পড়াশোনা। তাতে বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিতও হচ্ছে তারা। তারপর আবার কোথাও নোঙর ফেললে আবার নতুন স্কুল। এ যেন এক অভিনব যাপনচিত্র।
তবে সমুদ্রভ্রমণের নেশা নতুন নয়। বিগত এক দশক ধরেই বিভিন্ন সমুদ্র অভিযান করে আসছেন তাঁরা। তবে পরিকল্পনা থাকলেও এত দীর্ঘ ভ্রমণ এর আগে করেননি। বাধ সাধত সময়। করোনাভাইরাস লকডাউন যেন সেই সুযোগটাই এনে দিয়েছে তাঁদের হাতে। ডমোনকোস জানান, প্রাথমিকভাবে যাত্রা শুরুর সময় তাঁরা ভেবেছিলেন, বছর খানেকের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই দেশে ফিরবেন তাঁরা। তবে এই অভিযানের ঘোর বদলে দিয়েছে তাঁদের ভ্রমণের নীল-নকশাকে। হয়তো আগামী ৫-৬ বছর এভাবেই কাটাতে পারেন তাঁরা অস্থির সমুদ্রের মাঝে। ইচ্ছে রয়েছে প্রশান্ত এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও ঘুরে বেড়ানোর। সত্যিই এ যেন এক রূপকথার জীবন…
আরও পড়ুন
এশিয়া থেকে নৌকোয় করে আমেরিকায় পৌঁছেছিল আধুনিক মানুষ, জানাচ্ছে গবেষণা
Powered by Froala Editor