তার বিজ্ঞাপনে লেখা থাকত - "এই দারুণ গরমের দিনে - আরামে থাকা যায়, যদি প্রতিদিন স্নানে ও প্রসাধনে থাকে ক্যালকাটা কেমিকোর সুগন্ধি নিম টয়লেট সাবান… মার্গো'।
এবারও গরম পড়ছে তার নিয়মমাফিক। গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর দৌলতে গরমের দাপট বেশিই। তবু কতজনেরই বা মার্গোর কথা মনে পড়ে? এত বৈচিত্র্যেদর সাবান, বডিওয়াশের যুগে… মার্গো তো বুড়ো। কিন্তু সত্যিই একসময় মন কেড়েছিল মার্গো সাবান। শুধু বাঙালিরই নয়। গোটা ভারতেই রমরমিয়ে চলত মার্গো সাবানের রাজত্ব। গাঢ় সবুজ রঙের, নিমের গন্ধে ভেজা সেই সাবানের স্মৃতি আমাদের শৈশব জুড়ে। এতরকমের রংচঙে সাবানের দিন তখনও আসেনি। শৈশব ফুরোল, সঙ্গে সঙ্গে মার্গোর জমানাও। এই বছর সেই মার্গো সাবানই একশোতে পড়ল। শতবর্ষ যাকে বলে। তা কে ছিলেন এই মার্গো সাবানের জন্মদাতা? আর কোথায়ই বা ছিল তার আঁতুড়ঘর?
রাসবিহারী হয়ে ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের মোড়। সেখান থেকে বাঁদিকে সোজা চলে গেলেই ৩৫ নম্বর পণ্ডিতিয়া রোড। আজ এক সুউচ্চ বাড়ি বটে! বিলাশবহুল, আধুনিক সমস্ত সু্যোগসুবিধায়-ভরা চোখ-ধাঁধানো অ্যাপার্টমেন্ট। কে বলবে মাত্র বছর কুড়ি আগেও সেখানে ছিল বিখ্যাত ক্যালকাটা কেমিক্যাল কোম্পানি। ১৯১৬ সালে খগেনচন্দ্র দাশের হাতে তৈরি। পদবি দাশগুপ্ত যদিও। কিন্তু নাম থেকে বৈদ্য-পরিচয় ঘোচাতে গুপ্ত বাদ দিলেন। জাতপাতের বিরুদ্ধে এভাবেই প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সেসময়। কী আশ্চর্য না! আজও এই দেশ জাতপাতের সীমায় আটকে। একশো বছরে এতটুকু বদল হল না?
অবশ্য বদলাতে চেয়েছিলেন খগেনচন্দ্রের মতো মানুষেরা। পিতা ছিলেন আদালতের বিচারক, তায় রায়বাহাদুর উপাধিধারী। ইংরেজ অফিশিয়ালদের সঙ্গে নিত্য ওঠাবসা। আর মা ছিলেন মোহিনী দেবী। আজীবন গান্ধীবাদী। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির মুখপাত্র। কীভাবে যেন মায়ের প্রভাবই বেশি পড়েছিল খগেন্দ্রনাথের জীবনে।
পড়াশোনা শেষ করে শিবপুর কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন খগেনচন্দ্র। আর সেখানে জড়িয়ে পড়েন ব্রিটিশ বিরোধী বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। সে যাত্রায় গ্রেপ্তারির হাত থেকে ছেলেকে বাঁচাতে তাঁর পিতা তাঁকে রাতারাতি বিলেতে পাঠান। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ও পরে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রের পড়াশোনা শেষ করেন। এইসময় তাঁর সহপাঠী ছিলেন সুরেন্দ্রমোহন বসু। পরবর্তীকালে ইনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিখ্যাত ডাকব্যাক। যাইহোক বিলেতে থাকতে খগেনচন্দ্র লালা হরদয়ালের কাজেরও অন্যতম সঙ্গী হয়ে ওঠেন।
আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবসা শুরু, ৭৮ বছর ধরে বাঙালির ভরসা কে. সি. পালের ছাতা
পড়াশোনা শেষে জাপান ঘুরে অবশেষে কলকাতা। ৩৫ নম্বর পণ্ডিতিয়া রোডে তৈরি হয় ক্যালকাটা কেমিক্যাল। ১৯১৬ সালে। স্বদেশি হাওয়া তখন আকাশে বাতাসে। বিলিতি দ্রব্য বর্জনের হাঁকডাক সর্বত্র। কিন্তু দেশি জিনিসও তো চাই ব্যবহারের জন্যে। নিমের পাতায় তৈরি হল নিম সাবান, মার্গো। সঙ্গে নিম টুথপেস্ট। এছাড়া দেশের ভেষজ উপাদান ব্যবহার করে তৈরি করলেন মহাভৃঙ্গরাজ তেল, চেক ডিটারজেন্ট, ল্যাভেন্ডার ডিও পাউডার। সময়ের চাকা তখন পেরিয়ে গেছে আরও চারটে বছর। ১৯২০। স্বদেশি আমলে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিল এই ক্যালকাটা কেমিক্যাল। বাড়ি বাড়ি পৌঁছে গেল মার্গো, ল্যাভেন্ডারের সুগন্ধি। বিলেতকে বাতিল করে নতুনভাবে দেশ গড়ার সময় তখন। সেই কাজেই হাত দিয়েছিলেন খগেনচন্দ্র দাস ও আরো অনেকে। পণ্ডিতিয়ার পুরোনো বাসিন্দারা আজও মনে করতে পারেন, এলাকা জুড়ে মার্গোর গন্ধ। বাস্তবিকই বাঙালির সে এক অহঙ্কারের গল্প।
পরে অবশ্য কলকাতা ও বাংলা ছাড়িয়ে ক্যালকাটা কেমিক্যাল পাড়ি দিয়েছিল তামিলনাড়ুতে, তারপরে এশিয়ার অন্যান্য নানান দেশে।
আরও পড়ুন
বর্ধমান থেকে কলকাতায় এসে ব্যবসা শুরু, নীরবেই চলে গেলেন বিস্কফার্মের কর্ণধার কৃষ্ণদাস পাল
সময় যায়, দুঃসময় আসে। খগেনচন্দ্রের মৃত্যুর পরে তাঁর বংশধরেরা হাল ধরেছিল কারখানার। কিন্তু যা হয় আরকি…. ২০০১ সালে মার্গো সাবানের ব্র্যাুন্ডভ্যালু দাঁড়িয়েছিল নাকি ৭৫ কোটি টাকা। জাপানের বিখ্যাত বহুজাতিক কোম্পানি হেঙ্কেলের কাছে তা বিক্রি হয়ে যায়।
আজও মার্গো সাবান বেরোয়। তাতে অবশ্য বাংলার বা স্বদেশি যুগের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই।
আরও পড়ুন
৮৪ বছরের ব্যবসায় ইতি, পরাজয় স্বীকার ক্যামেরা কোম্পানি অলিম্পাসের
পণ্ডিতিয়া রোডে আজও বেশ কিছু প্রাচীন ইমারত আছে। কেমন যেন মনে হয়, তারা আজও সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে পুরোনো স্বদেশি সময়টার। আর আছে কয়েকটি ছায়াসুনিবিড় গাছ। তাদেরই হাওয়ায় হাওয়ায় হয়তো একদিন ছড়িয়ে যেত মার্গো, ল্যাভেন্ডার ডিউয়ের সুগন্ধ- দূরে, অনেক দূরে। আজ একশো বছর পরেও সেই সুগন্ধের ইতিহাস অমলিন।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা - মলয় মুখার্জী
আরও পড়ুন
পিতৃতন্ত্রের গোড়ায় আঘাত পাঞ্জাবের ব্যবসায়ীর, জন্ম নিল 'গুপ্তা অ্যান্ড ডটার্স'
Powered by Froala Editor