বর্বরতার প্রতীক হয়ে আজও দাঁড়িয়ে বেলজিয়ামের ‘মানব চিড়িয়াখানা’

খাঁচা দিয়ে ঘেরা ক্ষুদ্র পরিসরে একটা অরণ্য। আয়তন বড়ো জোর এক বিঘা। তার মধ্যেই রয়েছে বেশ কিছু বাঁশের মাচা, পাতার ছাউনির ঘর। আগুনের চুলা, পোড়া কাঠ, মাটির তৈরি পাত্র, এমনকি বাদ্যযন্ত্রও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতস্তত। দেখলেই বোঝা যায় সেখানে মানুষ বসবাস করে। কিন্তু এভাবে খাঁচা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে কেন গোটা অঞ্চলটাকে? তাঁরা কি যুদ্ধবন্দি নাকি স্রেফ প্রদর্শনী? মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেরিয়ে আসবে ‘চিড়িয়াখানা’ শব্দটা।

হ্যাঁ, ‘মানব চিড়িয়াখানা’ (Human Zoo)। উনিশ শতকের শেষে বেলজিয়ামের (Belgium) বুকে গড়ে উঠেছিল এমনই একটি অদ্ভুত ও নৃশংস প্রদর্শনীশালা। যেখানে আটকে রাখা হত আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের। দু’-একজন নয়, বিভিন্ন উপজাতির মানুষদের পৃথক পৃথকভাবে বন্দি করে এনে রাখা হত এই চিড়িয়াখানায়। এই চিড়িয়াখানাকে ঔপনিবেশিক বর্বরতার চরমতম উদাহরণ বললেও ভুল হয় না কোনো। 

১৮৯৭ সাল। বেলজিয়ামের রাজা তখন দ্বিতীয় লিওপোল্ড। তাঁর রাজত্বেই ব্রাসেলসের কাছে টেরভুরেনে গড়ে উঠেছিল এই মানব চিড়িয়াখানা। যা কিনা ছিল রাজারই মস্তিষ্কপ্রসূত। উনিশ শতকের শুরুর দিকেই আফ্রিকাতে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল বেলজিয়াম। দ্বিতীয় লিওপোল্ডের আমলে সেই ঔপনিবেশিক রাজত্বের পরিধি পৌঁছায় সর্বোচ্চে। যার আয়তন ছিল যুকরাজ্যের বর্তমান আয়তনের প্রায় ৬০ শতাংশ। 

‘বেলজিয়ান কঙ্গো’ নামে পরিচিত আফ্রিকান এই উপনিবেশে গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন চলতই। পাশাপাশি স্বমহিমায় প্রচলিত ছিল ক্রীতদাস প্রথা। বেলজিয়ান শাসকদের নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় লক্ষাধিক আফ্রিকান। মাতৃভূমি ছাড়তে হয়েছিল আরও বহু মানুষকে। এসবের বাইরে চিড়িয়াখানায় বন্দি করে আনা হয়েছিল ২৬০ জন ভিন্ন ভিন্ন উপজাতির মানুষদের। তাঁরাই ছিল বেলজিয়ান কঙ্গোর ‘মুখপত্র’। প্রদর্শনী তো বটেই, তাছাড়াও এই চিড়িয়াখানা ব্যবহৃত হত উদ্যোগপতিদের ঔপনিবেশিক ব্যবসায় বিনিয়োগ করানোর জন্য। অনেকটা বিজ্ঞাপনের মতো। 

আরও পড়ুন
এভারেস্ট-অভিযানে শুধুমাত্র কৃষ্ণাঙ্গরা, এই প্রথম

১৯৫৮ সালে বন্ধ হয়ে যায় এই বর্বর প্রথা। তবে সেখানকার মানুষদের মুক্তি মিললেও, আজও বেঁচে আছে সেই ঔপনিবেশিকতার ছাপ। তাঁদের ব্যবহৃত সামগ্রী এবং অন্যান্য জিনিসপত্র সংরক্ষিত আছে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের মিউজিয়ামে। 

আরও পড়ুন
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা হিসাবে মার্কিন মুদ্রায় সাহিত্যিক মায়া অ্যাঞ্জেলু

সম্প্রতি ব্রাসেলসে আয়োজিত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের শীর্ষ সম্মেলনে, বেলজিয়াম প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সেখানে হাজির হয়েছিলেন কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী সামা লুকোন্ডে। তাঁর উপস্থিতিতেই প্রায় ৮৪ হাজার কঙ্গোলিজ প্রত্নবস্তু ও অন্যান্য সামগ্রী হস্তান্তর করে বেলজিয়াম। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থনাও করেছে ইউরোপীয় রাষ্ট্রটি। দেওয়া হয়েছে ক্ষতিপূরণের আশ্বাস। তবে বেলজিয়ান প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার ডি ক্রু-এর অভিমত, বন্ধ করা হবে না বেলজিয়ামের মানব চিড়িয়াখানার মিউজিয়াম। ঔপনিবেশিক শাসন এবং দেশের নৃশংস অতীতও ইতিহাসেরই সাক্ষ। আগামী প্রজন্মের কাছেও তার অতীতকে উপস্থাপন করা সমানভাবে জরুরি বলেই মনে করেন তিনি। বৈষম্যের বিরুদ্ধেই এই জাদুঘরকে হাতিয়ার করতে চান আলেকজান্ডার। এও এক অভিনব উদ্যোগ…

আরও পড়ুন
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা হিসেবে অস্কারজয়; সিডনি পোয়েটার ও দিনবদলের কাহিনি

Powered by Froala Editor