হস্তিনানগরীর উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন একলব্য, বিচিত্র অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলেন পথে

মহাভারতে রাজনীতি - ২৪
আগের পর্বে

দ্রোণের কথা শুনে ভীষ্ম প্রশ্ন করলেন তিনি ব্রাহ্মণ হয়ে কীভাবে অস্ত্রচর্চা করেন। দ্রোণ জানালেন, যেহেতু কৃপাচার্যকে স্বয়ং মহারাজ শান্তনু অনুমতি দিয়েছেন তাই তাঁর ক্ষেত্রেও বাধা থাকার কথা নয়। রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষার দায়িত্ব নিলেন দ্রোণাচার্য। পুত্র অশ্বত্থামার প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকলেও ধনুর্বিদ্যায় অর্জুনের পারদর্শিতা তাঁকে মুগ্ধ করে। কুরুবংশের বাইরেও বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশের শিশুদের অস্ত্রশিক্ষার দায়িত্ব নিলেন তিনি। এই সময়েই তাঁর কাছে অস্ত্রশিক্ষার জন্য আসেন সূতপুত্র কর্ণ এবং নিষাদ বংশের একলব্য। একলব্যকে চেদিরাজ্যে থেকেই অস্ত্রশিক্ষা করতে বলেছিলেন শিশুপাল। কিন্তু একলব্য বলেছিলেন, দ্রোণাচার্যের নাম তাঁকে টানছে।

উপরিচরের শুক্র পান করে অপ্সরা মৎসী গর্ভবতী হয়। অপ্সরারা অপ বা জলে বিচরণ করে। দশম মাসে ওই মৎসী ধরা পড়ল এক ধীবরের জালে। অদ্রিকা তখন একটি পুত্র ও একটি কন্যা প্রসব করে আকাশপথে চলে যায়। উপরিচর বসু পুত্রটিকে গ্রহণ করলেন, কন্যাটিকে পরিত্যাগ করলেন। সেই কন্যা বড়ো হতে লাগল ধীবর দাশরাজের গৃহে। তার নাম মৎস্যগন্ধা। উপরিচরকে চেদি রাজ্য থেকে অনেক কষ্টে সরানো গিয়েছে। তবে তাঁর কন্যা মৎস্যগন্ধা এখন হস্তিনা শাসন করে। সেও পিতার মতো ষষ্ঠীর নিয়মিত পুজো করে, ভোগ দেয়।   

এই পর্যন্ত বলে থামলেন চেদির রাজা শিশুপাল। বললেন, বাছা একলব্য এখন ঘুমিয়ে পড়ো। ভোর-ভোর বেরিয়ে উত্তরপানে যাবে। পথে পড়বে ইলাবাস, সেখানে বিশ্রাম নিয়ে বিরাট রাজ্যের ভেতর দিয়ে অনেকটা গিয়ে মৎস্য দেশ পার হয়ে পাবে খাণ্ডব বন। সেই বনের উত্তরে আছে হস্তিনানগরী।

চেদি দেশ থেকে বিদায় নিয়ে নতুন ঘোড়ায় চড়ে একলব্য উত্তর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। পথে শুধু ধু ধু প্রান্তর, বন আর নদীনালা। বেশ কিছু দিন পর তিনি ইলাবাসের প্রয়াগতীর্থ পার হয়ে বিরাট রাজ্যে এসে কয়েক দিন বিশ্রাম নিলেন। সেখানকার রাজার নামও বিরাট। তিনি অলস প্রকৃতির রাজা, সারা দিন পাশা খেলে সময় কাটান। শিশুপালের নাম করে রাজ অতিথিশালায় কিছু দিন বাস করার সুযোগ পেলেন। সেই সুযোগে আলাপ হল বিরাট রাজার প্রধান মহিষী সুদেষ্ণার ভাই কীচকের সঙ্গে। কীচক ভারি মজার লোক। তিনি বিরাট রাজ্যের সেনাপতি। তাঁর সঙ্গে তীরধনুক ও নানা অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে কথা হল একলব্যের। কীচক একলব্যকে বললেন, তুমি এখানে থেকে যাও। বিরাট রাজ্যের সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পেলেন একলব্য। হিরণ্যধনুর পুত্র জানালেন, কীচকের প্রস্তাব খুব সম্মানজনক কিন্তু তিনি হস্তিনায় একটি কাজে যাচ্ছেন, সেই কাজ শেষ করে এসে জানাবেন যে সেনাবাহিনীতে তিনি যোগ দেবেন কিনা। কীচক নানা রকমের সুরার ভক্ত, তাঁর সংগ্রহে অনেক রকম সুরা আছে। দু দিন ধরে একলব্যকে তিনি মাংস সহযোগে সেই সব পানীয় চেখে দেখার সুযোগ করে দিলেন। একলব্য তাঁকে কয়েকটি তীর ধনুকের কসরত শিখিয়ে দিলেন।

মৎস্য দেশের অন্দর দিয়ে খাণ্ডব বন পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগল না দ্রুতগামী অশ্বারোহী একলব্যের। পিতা হিরণ্যধনু বলেছিলেন, এখানে বাস করেন তক্ষক ও তার পুত্র অশ্বসেন। ময় দানব, ঋষি মন্দপাল এবং তার সঙ্গিনী জরিতাও থাকেন এই বনে। তাঁদের সঙ্গে দেখা করে, কয়েকটা দিন অরণ্যে বাস করে তবেই সে পৌঁছবে হস্তিনানগরে।  

আরও পড়ুন
দ্রোণাচার্যকে রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষার ভার দিলেন ভীষ্ম, দ্বিধাগ্রস্ত দ্রোণ

তক্ষকের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল একলব্যের। তিনি একলব্যকে নাগবংশের অনেক কাহনি শোনালেন। অষ্টনাগের অন্যতম তক্ষক ছদ্মবেশে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করেন কারণ নগরের লোকেরা তাঁকে বিদ্রোহী ভেবে হত্যা করতে চায়। শেষ নাগ ও বাসুকিও পাতালে চলে গিয়েছেন বহু দিন, সেখান থেকেই তাঁরা নিজেদের কাজকর্ম পরিচালনা করেন। নগরের ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছেন না কিছুতেই। অথচ কী আশ্চর্য! এখন জাতপাত নিয়ে যারা মাথা ঘামাচ্ছে, তারাও জানে তক্ষক ওরফে অনন্তনাগের পিতা কশ্যপ আর মা কদ্রু। তিনিই একলব্যকে বললেন, নিষাদ হয়ে হস্তিনায় গিয়ে আচার্য দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতে যাওয়া আর ইঁদুর হয়ে বেড়ালের গালে চুমু খেতে যাওয়া একই ব্যাপার। তার চেয়ে গুপ্তবিদ্যা শিখে যুদ্ধ করা অনেক ভালো। সম্মুখ সমরে রাজশক্তির সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল। কিন্তু একলব্য নাছোড়বান্দা। তিনি যাবেনই। মন্দপাল ঋষি ও তার সঙ্গিনী জরিতাও অনেক বোঝালেন। ময় দানব অবশ্য একটু চুপাচাপ। অনেক কাল অরণ্যবাস করে তাঁর মনে শান্তি নেই। তিনি বললেন, যাও খোকা! তুমি আচার্যের কাছে যাও।

খাণ্ডব বন পার হতে সময় লাগল না বেশি। হস্তিনার কাছাকাছি পৌঁছে কুরুজঙ্গলের সীমানায় একলব্য দেখলেন একটি অস্ত্রবাজার। সে সবের নিয়ন্ত্রণ করেন বৈশ্য কুলপতিরা। বশিষ্ঠের বৈবাহিক চিত্রমুখ নামের এক বৈশ্য পুরুষের পৌত্র অনন্তমুখ সেই বাজারের মালিক। একলব্য তাঁর তীরধনুক দেখালেন অনন্তমুখের প্রহরীদের। প্রহরী আবার ডেকে আনল দক্ষ বাজারুদের। তারা সব পরীক্ষা করে বলল, অর্ধেক তীরধনুক একলব্য এখানে বেচতে পারবেন, বাকি অর্ধেক তাদের দিতে হবে—এটাই বাজারের নিয়ম। 

আরও পড়ুন
গুরুপত্নীতে আসক্ত চন্দ্র, ক্রুদ্ধ বৃহস্পতি হাজির ইন্দ্রের দরবারে

একলব্য একটু রুষ্ট হল বটে কিন্তু তখনকার মতো মেনে নিল। তার বসার জায়গা হল বাজারের ম্লেচ্ছপট্টিতে। সেখানে বেশির ভাগ লোকের ভাষা বুঝতে পারে না একলব্য। মন দিয়ে শুনলে অবশ্য বোঝা যায়। ম্লেচ্ছপট্টিতে বসে ছুরি বিক্রি করছিল একজন প্রৌঢ় কামার। সে একলব্যকে জিজ্ঞাসা করল, কী ভায়া এই বাজারে নতুন নাকি?

একলব্যের ভাষার সঙ্গে তার কথার খুব মিল। তার পাশের ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসল সে। প্রৌঢ় বলল, তা কত নিল তোমার কাছ থেকে, অর্ধেক? নতুনে তাই নেয়। অনন্তমুখের বিরাট হাঁ।

আরও পড়ুন
ব্রাহ্মণ হয়েও অর্থনীতির চর্চা, সামাজিক সব গণ্ডি ভেঙে দিয়েছিলেন ভরদ্বাজ

একলব্য হেসে বসল কামারের পাশে। ধনুকের ফলার ধার দেখতে দেখতে একলব্য জিজ্ঞাসা করে, তা এই অনন্তমুখ লোকটা কে খুড়ো?
“সে অনেক কাহিনি রে ভাইপো! এই লোক হল রাজমাতা মৎস্যগন্ধার আগের পক্ষের আত্মীয়।”
মৎস্যগন্ধা নামটা খুব চেনা চেনা লাগল। তিনিই তো এখন রাজমাতা। তাঁর পৌত্র ধৃতরাষ্ট্র এখন হস্তিনার রাজা।
কামার বলে, অনন্তমুখ সত্যবতীর আগের পক্ষের বর পরাশরের মামাতো ভাই। বয়স হয়েছে ভালোই। তার ছেলে দুর্মুখ এখন বাজার সামলায়। সে আবার সম্পর্কে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের ভাই কিনা!

একলব্য ভাবে, এ তো ভারি জটিল অঙ্ক। সে কথা বাড়ায় না। বেশ কয়েকজন খদ্দের সামনে দিয়ে হেঁটে গেল কিন্তু তার দিকে ভ্রুক্ষেপই করল না। একলব্য চুপচাপ বসে রইল। ওদিকে কামারের সব ছুরি ভুজালি বিক্রি হয়ে গেল। বাড়ি যাওয়ার আয়োজনের ফাঁকে কামার একটি আতা ফল দিল একলব্যকে। বলল, বাড়ির উঠোনে ফলেছে, তোকে দিয়ে গেলাম। এই আতা খুব ফলদায়ী, দেখিস কাল তোর নসিব খুলে যাবে।
একলব্য কামারকে বলল, ও খুড়ো একটা কথা ছিল।
“বল।”
“রাতটা তোমার বাড়িতে থাকতে দেবে?”
“না রে বাপ! আমার বাড়িতে সোমত্ত কন্যা আছে।”
একলব্য তার পা চেপে ধরে বলল, তোমার কন্যা মানে আমার ভগ্নী। না কোরো না খুড়ো।
“বেশ, চল তবে। কিন্তু ভাইপো, ঝামেলা করলে, তোর খুড়ি কিন্তু দুজনকেই আঁশবটি দিয়ে কেটে ফেলবে।”
“মা কালীর দিব্যি।”

আরও পড়ুন
কালকূট খাওয়ালেন দুর্যোধন, গঙ্গার তীরে বেহুঁশ মহাপরাক্রম ভীম

দুজনে বাজার থেকে বের হয়। বাইরে একলব্যের ঘোড়াটা মাঠে বড় দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। একলব্য কামারকে বলে, কাকা! ঘোড়াটা নিয়ে আসি।
কামার অবাক হয়ে বলে, ওরে রাজপুত্তুর! তোর আবার ঘোড়াও আছে। একেই বলে গরিবের ঘোড়া রোগ।

একলব্য ঘোড়ায় চাপে। পিছনে বসিয়ে নেয় কামারকে। তার পর নির্দেশিত পথে ছুটিয়ে দেয় অশ্ব।

কামারের বাড়ি হস্তিনার উত্তরে। অস্ত্রবাজার থেকে কুরুক্ষেত্র পার হয়ে সে অনেক রাস্তা।  বেশ গোছানো বাড়ি। কামারের বউ আর মেয়ে বেশ খাতিরযত্ন করল তার। জল এনে দিল। খেতে দিল যত্ন করে। কামার সদোপবাসী মানুষ—দিনে মাত্র দু বার আহার গ্রহণ করে। যেদিন অস্ত্রবাজারে যান সেদিন সকালে খেয়ে যায় আবার রাতে ফিরে খায়। একলব্যের তেমন হলে চলবে না। ব্রীহি ও যব এদের প্রধান খাদ্য। মাংসভক্ষণ করে না বললেই চলে। কামার মাঝেমধ্যে সুরাপান করে, সে কথা একলব্য তার মুখ থেকেই শুনেছে।

যবাগু আর ভর্জিত বার্তাকু দিয়ে নৈশ ভোজন সেরে কামারের সঙ্গে এক ঘরে শুয়ে পড়ল একলব্য। কামার তাকে বলল, হস্তিনার আখ্যান শুনেছিস?
একলব্য জবাব দেয়, না।
“খুব শীঘ্র একটা যুদ্ধ হবে।”
“কার সঙ্গে কার?”
কামার বলে, ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের। সে অনেক বড় কাহিনি। শুনবি?
“বলো।”

অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা

Powered by Froala Editor

More From Author See More