একটা ফোটোগ্রাফ, গ্লানিবোধ আর মাস্টারমশাই

শঙ্কর-সরণি - ৪
আগের পর্বে

কিশোর বয়সেই হেমাঙ্গিনীর কোলে এসেছিলেন উদয় শঙ্কর। দাদুর বাড়িতে বেশ আদরেই বড়ো হয়েছেন তিনি। নসরতপুরের বাড়িতে অনেক দৌরাত্ম্য করেছেন। কিন্তু হেমাঙ্গিনী কিছুটা প্রশ্রয় দিয়েছেন। অবশ্য একদিন দেয়ালে ছবি আঁকার জন্য মামার হাতে চড় খেলেন। শ্যামশঙ্কর বিদেশ থেকে রঙের বাক্স পাঠিয়েছিলেন ছেলের জন্য। সেই উপহার উদয় শঙ্করের হাতে পৌঁছয়নি। দাদু বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। নসরতপুর থেকে চলে গিয়েছিলেন বেণারস। তখনই ফিরে আসেন শ্যামশঙ্কর। তাঁর কাজের সূত্রে চলে যেতে হয় রাজস্থানের ঝালোয়ারে। রাজস্থানের বর্ণময় রূপ মুগ্ধ করেছিল উদয় শঙ্করকে। তবে বাবাকে কাছে পেলেও দূরত্ব থেকেই যায়। শ্যামশঙ্করের পড়াশোনা আর কাজের ঘেরাটোপে ছেলেদের উঁকি দেওয়ার উপায় ছিল না।

গাজিপুরে ফিরে ফের ইস্কুলে ভর্তি হলেন উদয়শঙ্কর। কিন্তু ইস্কুল তাঁকে কিছুতেই টানে না। সে চত্বরের বাধা-নিষেধ-শাসন-শাস্তি আর গতানুগতিক রোজনামচায় তাঁর তীব্র অনীহা। বরং গ্রামের ধূ-ধূ উধাও প্রান্তরে প্রকৃতির মধ্যে অথবা কখনও জীবনের আনাচে-কানাচে টহল দিয়ে বেড়ানোতেই তাঁর আনন্দ। প্রজাদের জীবনের অলিতে-গলিতেও তাঁর অবাধ যাতায়াত।

গ্রামের প্রান্তে ছিল অন্ত্যজদের ঘর। ডোম-চামাররা নিজেদের কাজ-কর্ম, জীবন-জীবিকা নিয়ে মূল পল্লীসমাজ থেকে সরে-সরেই থাকত। তাদের বাঁচা-মরা আনন্দ-উৎসব থেকে গ্রামও তটস্থ তফাতে রাখত নিজেদের। একদিন ঘন নিকষ কালো অন্ধকারে উদয় দেখলেন মশালের আগুন আলো হয়ে উড়ছে আকাশে। তার সঙ্গে ঢোলের বোল ধরেছে আবেশ। বাতাসে যেন কীসের স্ফূর্তি। উদয় জানেন, গ্রামের সাধারণ মানুষের পক্ষে তো বটেই, তার ওপর জমিদারির বাড়ির লোকজনের পক্ষে কী ভীষণ নিষিদ্ধ এই জনস্থান। তবু তিনি গেলেন। দেখলেন আলোয় ভেসে যাচ্ছে ওই সংকীর্ণ দাওয়াটুকু। মানুষগুলো যেন আনখশির মদ্যপান করে হুল্লোড়ের খেই ধরে মেতে উঠছে চিৎকারে-চিৎকারে। দেখলেন, মাথাভর্তি ঝাঁকরা চুল, কুচকুচে গায়ের রঙ নিয়ে সুঠাম, সৌম্যদর্শন এক যুবক। ওই সুর-তাল-লয় আর বুঝি জড়ো-করা ভুবনের যত আনন্দ আর উদ্দীপনাকে গায়ে জড়িয়ে নেচে চলেছে সে। ঝাঁকরা চুল হেলিয়ে-হেলিয়ে পড়ছে মুখের ওপরে। নাচ বুঝি দোলা দিয়েছে তার মর্মে। ঠাহর করে দেখলেন উদয়, এ তো চামার মাতাদিন। তিনি তো চেনেন একে। আজ বুঝি তাকে নতুন করে জানলেন। সেই দিনটি চিরদিনের জন্য ছাপ ফেলেছিল তাঁর মনে। যখন তিনি খ্যাতির শীর্ষে, তখন একবার এসেছিলেন এই গ্রামে, ফিরেই খোঁজ করেছিলেন এই মাতাদিনের।

এখানেই তিনি দেখেছিলেন জিপসিদের। জমিদার বাড়ির লাগোয়া উঠোনে বসেছে পসরা। চলছে মনোহারি জিনিসের বিকিকিনি। তাদের চেহারা আর সকলের চেয়ে আলাদা। আলগা জামা। চোখে কাজল। গলায় ঝোলানো হাজারো পুঁতির মালা আর গা-ভর্তি নকসা। উল্কি। সাধারণের চাইতে রঙ-ঢং সবই বুঝি আলাদা। কিন্তু মানুষ দেখার নেশা একদিন তাঁকে ফেলল বিপাকে। বন্ধুরা তাঁকে নিয়ে গেল, তিনি শুনলেন নাচ-গান হয় সেখানে। গাজিপুর ছিল গোলাপজলের উৎস। অভ্যর্থনায় ছিল যে মেয়ে, ঘাগরা-চোলিতে তার ঠাট-ঠমক ছিল দেখবার মতো, সবিশেষ সেই সুগন্ধীতে সে পথ চিনিয়ে নিয়ে গেল ভেতরে। বন্ধুরা তামাশায় বিভোর হয়ে উঠল। উদয় মন দিয়ে দেখলেন নাচ, খানিক কত্থক ভঙ্গির ধাঁচে-ফেলা সে নৃত্য। কিছুক্ষণ দেখবার পর কী মনে হল বন্ধুদের ফেলে রেখে একাই বেরিয়ে এলেন পথে।

হেমাঙ্গিনী তাঁর সাধ্যমতো সংশোধনের চেষ্টা করতেন উদয়কে। স্নেহ আর শাসনের যে ওতপ্রোত সহজাত ধারা, তিনি সন্তানদের লালন করতেন সেভাবেই। সন্তান সুবোধ না হলে সংসারে মেয়েদের সংকটটাও এক রকম বুঝতেন উদয়। তিনি তখন কিশোর। চেষ্টা করতেন। আর তারপরই কেমন সব তালগোল পাকিয়ে উঠত।

আরও পড়ুন
বাবার পাঠানো উপহার হাতে পেলেন না উদয়

মিকেলেঞ্জেলোর সৃজন

 

না, মাতামহ অভয়চরণের কাছে চাপা রইল না সে খবর। উদয় গিয়েছিল বাঈ-নাচ দেখতে, এমন অকল্পনীয় বিষয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। এতদিন উদয়ের স্বভাব নিয়ে তাঁর অসন্তোষ ছিল। বিরক্তি ছিল। বকা-ঝকা দিয়েই চলছিল গড়ে-পিটে নেওয়ার কাজ। কিন্তু বনেদি বাড়ির শিষ্টতার ঐতিহ্য বহু পুরনো। সেই দস্তুরকে উল্লঙ্ঘন করার স্পর্ধাকে মেনে নিলেন না তিনি। মাতামহ নয়, যেন জমিদারের দম্ভ, ক্রোধ তদুপরি পীড়নের সুদীর্ঘ ইতিহাসকেই সেদিন প্রত্যক্ষ করলেন উদয়। নির্মম প্রহার নেমে এল তাঁর ওপর। দরজার আড়ালে নিথর দাঁড়িয়ে রইলেন হেমাঙ্গিনী। দাস-দাসী-পরিজনরা দেখল পাথরের প্রতিমা ভেসে যাচ্ছে অশ্রুধারায়।          

আরও পড়ুন
হেমাঙ্গিনী দেবী: মনের দিক থেকে একলা রেখেছিলেন নিজেকে

অভয়চরণ সিদ্ধান্ত নিলেন খাপছাড়া এই স্বভাবকে কিছুতেই রেয়াত করবেন না তিনি। নতুন করে ইস্কুলে ভর্তি করা হল তাকে। সেই স্কুলের এক মাস্টারমশাই মামার বন্ধু। তাঁকেই দেওয়া হল দায়িত্ব। প্রথম দিনের ক্লাসেই সেই শিক্ষকের ব্যবহার যথেষ্ট অশ্রদ্ধেয় মনে হল তাঁর। পড়াশোনার প্রতি ভেতর ভেতর ফের বিরূপ হয়ে ওঠার সময়ই ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। স্কুল নয়, কিন্তু আঁকার ক্লাসটা যার-পর-নাই ভালো লেগে গেল তাঁর। আঁকার ক্লাসের চেয়েও, বলা ভালো, ভালো লেগে গেল, আঁকার মাস্টারমশাই, অম্বিকাচরণ মুখোপাধ্যায়কে। রাজস্থান তাঁর চোখের পৃথিবীকে বিস্তৃততর করেছিল, মনকে আশ্রয় আর শিক্ষা যিনি দিয়েছিলেন, তিনি অম্বিকাচরণ। বদলে গেলেন উদয়। বেলাগাম, নাছোড়, দিগভ্রান্ত কিশোরটির ভেতর থেকে প্রকাশ পেল এক অন্য মানুষ ।

অভয়চরণের বাড়ির অদূরেই অম্বিকাচরণের বাড়ি। নির্জন তাঁর বাড়ি। পরিচ্ছন্ন। অম্বিকাচরণ আর তাঁর বাড়ি, যেন একটা সত্তারই দুটো প্রকাশ। বিশ্বের বিবিধ বিষয়ে তাঁর আগ্রহ যেন স্রোতস্বিনীর মতো ঢেউ তুলে রেখেছে বাইরে দিকটাতে। অথচ স্বভাবের ভেতরটা নদীর গভীর তলদেশের মতোই শান্ত, সংহত। থরে থরে সাজানো বই। গুছিয়ে রাখা আঁকার সরঞ্জাম। গরিব দুঃখীদের জন্য অম্বিকা শিখেছেন হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা পদ্ধতি। হোমিওপ্যাথির বাক্সের পাশেই আছে সেতার। চিত্রকলা, সংগীত আর বইয়ের মধ্যে বসত হলেও অম্বিকার অপ্রতিরোধ্য আগ্রহ ম্যাজিক নিয়েও। ঘরের ভেতর মজুত থাকত রকমারি আজব টুকিটাকি। এই গৃহে ছিল উদয়ের অবারিত দ্বার। উদয় নিশ্চয়ই টের পেতেন, এর চেয়ে ভালো ইস্কুলবাড়ি তিনি আর কখনও দেখেননি। 

আরও পড়ুন
শঙ্কর সরণি। ১ || অমলার শৈশব-স্মৃতি : ছুটে বেড়াতেন ফুল আর গন্ধের খোঁজে

অম্বিকাচরণ তাঁকে রেখা শেখালেন। আকার। চেহারা। রূপ। আর শেখালেন রং। হাতে গুলে দেখাতেন রং। আর দেখাতেন সেইসব রংকে মিশতে দিলে কেমন নিমেষে তারা ফুটে উঠবে আরো আরো রং হয়ে। বাঁধা-ধরা ইস্কুলের পড়ায় যে, ছাত্রর মন ওঠে না, বুঝলেন অম্বিকা। মনে মনে ভাবলেন বোধহয়, দেখাই আর শেখাই যদি আসল হয়, তবে স্থান দিয়ে তাকে সংকীর্ণ করা কেন? ছবিতে-ছবিতেই থেমে থাকল না চর্চা। সকাল-সকাল মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি পৌঁছে উদয় কোনোদিন উঠে পড়ে লাগে রান্নার উদযোগে। ছাত্রের ইচ্ছায় অম্বিকা তাঁর দেশের বাড়ি থেকে আনিয়ে নিলেন হারমোনিয়ম। গান গায় উদয়। কখনও উদাত্ত গলার যুগলবন্দিতে কাবার হয়ে যায় দিন। কখনও বাঁশি বাজায় তো কখনও ম্যাজিকের গোড়ার কসরতগুলোতে হাত পাকায় উদয়।

বিচিত্রের দিকে ছাত্রর মনকে ঘুরিয়ে আবার শমেও ফিরিয়ে আনতেন অম্বিকাচরণ। শিল্পীকে যেমন বহুর কাছে পৌঁছতে হয়, তেমনই ফিরতে হয় নিজের কাছেও। একলা হতেও জানতে হয়। সন্ধেবেলা ঝিঁ ঝিঁ ডাক পাড়ত। কাজ-ফুরানিয়া দিনশেষে, তখন তাঁকে পড়ে শোনাতেন চণ্ডীদাসের পদ। একদিন ম্যাজিকের কথায় তাঁকে শোনালেন কালিদাসের কালেও ভারতবর্ষ দড়ি দিয়ে কতরকম দৃষ্টিভ্রম তৈরি করেছে, ইংরেজও যে খেলা দেখে, যাকে বলে একেবারে তাজ্জব। ওই দড়ির কারসাজিকেই তারা নাম দিলে ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিক। আরেকদিন হঠাৎ টেবিল থেকে দুটো চিনেমাটির বাটি তুলে চোখের সামনে এনে, দূরে বসিয়ে, বাঁদিকে ঠেলে ডানদিকে উঠিয়ে বোঝালেন কাকে বলে পার্সপেক্টিভ। একটাই জিনিস অথচ যতবার দৃষ্টির বদল হবে ততবার নতুন জন্ম নেবে আকৃতি। তারপর, ধুত্তোর সব উড়িয়ে দিয়ে বললেন, এ সবই অর্থহীন, আসল কথা হল আর্টিস্টের অর্ন্তদৃষ্টি। মন যা দেখবে আসলে তাই ছবি।

মাস্টারমশাইয়ের কাছেই উদয় প্রথম শুনলেন, নবজাগরণ-পর্বের দুই পুরোধাস্থানীয় শিল্পী বতিচেলি আর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির কথা। শুনলেন, শিল্পীর নামেও কখনও নামকরণ করা হয়েছে রঙের, টিসিয়ন রেড। একদিন অলস হয়ে বাঁশি বাজাবার সময় মাস্টারমশাই তাঁকে বোঝালেন, বৈষ্ণব পদাবলিতে কী বিচিত্র অনুষঙ্গে বাঁশি আর প্রেমকে একাকার করে দিয়েছিলেন কবিরা। কখনও ধীরে ধীরে সময় বয়ে যাওয়া মুহূর্তে অম্বিকা তাঁকে পড়াতেন তাঁর প্রিয় রবীন্দ্রনাথ। আমার চিত্তে তোমার সৃষ্টিখানি,/ রচিয়া তুলিছে বিচিত্রতর বাণী। নিজের মধ্যে এক মগ্ন শ্রোতাকে দেখলেন উদয়।

অম্বিকাচরণ উদয়কে উপহার দিলেন একটা ক্যামেরা। বলে দিলেন, মুহূর্ত আর আলো এই দুইয়ের সমীকরণ কতটা জরুরি এ ব্যাপারে। ব্যস, মাঠ-ঘাট-জল-জঙ্গল উদয়ের ছবির বিষয় হিসেবে বাদ পড়ল না কিছুই। এমনই একদিন, ছায়ানিবিড় জনহীন নৈঃশব্দ্যে একাকী এক অপরূপ নারীকে দেখলেন উদয়। আত্মমগ্ন সে স্নান করছে নদীর জলে। জলস্পর্শমাত্র যেন প্রকট হয়ে উঠছে তার পূর্ণযৌবন। উদয় ছবি তুললেন। ধীরে, অতি ধীরে। স্নানশেষে বিবসনা সেই নারীমূর্তিকেও উদয় দেখলেন পরম যত্নে। ব্যর্থ হতে দিলেন না সেই ক্ষণকে, ধরে রাখলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর মনে হল, তিনি অন্যায় করলেন, পাপ। আত্মগ্লানি অস্থির করে তুলল তাঁকে।  তিনি মনস্থির করলেন, অপরাধ স্বীকার আর শাস্তিগ্রহণেই পাপক্ষালন করবেন তিনি। কিছু না বলে মাস্টারমশাইয়ের হাতে তুলে দিলেন ছবির রিল। দাঁড়িয়ে রইলেন একপ্রান্তে। ভয় আর লজ্জায় কুণ্ঠিত প্রতি মুহূর্তকে যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মনে হল তাঁর। ছবির নেগেটিভ নিজেই ওয়াশ করতেন অম্বিকা। জল থেকে ছবি ভেসে উঠছে একে একে। অম্বিকা বিনা বাক্যব্যয়ে কাজ করছেন। কাজ শেষ হলে, ছবি হাতে ধরে অনেকক্ষণ দেখলেন, তারপর বললেন, বাহ। 

অম্বিকা যথার্থ শিক্ষক ছিলেন। তিনি বুঝলেন। মানুষের অজ্ঞাতে নগ্নতাকে দেখতে চাওয়া নিশ্চয়ই পাপ। কিন্তু দৃশ্যের মধ্যে রং, রেখা, ভঙ্গির যে নান্দনিকতা, কিশোরকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে সেই শিল্পসত্তা। অম্বিকাচরণ সেদিনই উদয়কে শোনালেন রেনেসাঁস কালপর্বে মিকেলেঞ্জেলোর শিল্পে মানুষের শরীর আর শারীরিক উচ্চাবচতাকেই শিল্পে উন্নীত করার গল্প। ধীরে ধীরে পৃথিবীর চিত্রকলা আর ভাস্কর্যের হদিশ দিয়ে ক্ষুদ্রের সীমাকে পেরিয়ে ছাত্রের মনকে নিয়ে গেলেন এক বৃহত্তর ক্ষেত্রে। নিবিড় করে দেখা আর বিস্তৃত করে দেখার দুটি শিক্ষাই দিয়েছিলেন তিনি। সমস্ত কিছুকে সংস্কারমুক্ত হয়ে দেখতে পারার ক্ষমতাটি বোধহয় সেইদিনই লাভ করেছিলেন উদয়শঙ্কর।

Powered by Froala Editor