'কালাপানি' আন্দামান - ৬
আগের পর্বে
১৮৬০-এর দশকে উত্তর-পশ্চিম ফ্রন্টিয়ারের আম্বালা রেজিমেন্টের ঘোড়সওয়ার ছিলেন শের আলি। বেঙ্গল আর্মির এক মেজরের বাড়িতে কর্মরত অবস্থায় তাঁর এক আত্মীয়কে হত্যা করেন শের আলি। সেই অপরাধের জন্যই তিনি দ্বীপান্তরিত হন আন্দামানে। ১৮৬৭ সাল নাগাদ ভারতের বড়লাট লর্ড মেয়ো। দ্বীপান্তরের সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের জন্য বন্দিনিবাস নির্মাণের আলোচনা করতে মেয়ো উপস্থিত হয়েছিলেন আন্দামানে। সেখানেই তাঁর জন্য যে অপেক্ষা করে ছিল শমন। আন্দামানের কয়েকটি দ্বীপ ঘুরে রস আইল্যান্ডে তাঁর ফেরার পরই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পরলেন শের আলি। একের পর এক ছোরার আঘাত পিঠে। সন্ধে গড়ানোর আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন মেয়ো। পরে বিচারে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে পুরোপুরি নির্লিপ্ত ছিলেন শের আলি। ১৯৭২ সালে ১১ মার্চ ভাইপার দ্বীপে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাঁকে। তারপর...
আন্দামানে প্রথম যখন পেনাল সেটেলমেন্ট গড়ে উঠছিল তখন থেকেই ‘মহারাজা’ জাহাজে পালাক্রমে কলকাতা, মাদ্রাজ ও রেঙ্গুন থেকে প্রতি চল্লিশ দিন ঘুরেফিরে কয়েদি চালান আসত। আমরা বারীন্দ্র কুমার ঘোষের দ্বীপান্তরের কথা থেকে জানতে পারি সাধারণ কয়েদিদের চালান এলে প্রথমে তাদের হোপ টাউনের কাছে মাউন্ট হ্যারিয়েটের নিচে প্লেগ কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে তোলা হত। এই ক্যাম্প একজন কয়েদি কম্পাউন্ডার ও একজন কয়েদি জমাদারের অধীন। এখানে নতুন চালান এলে অন্য কয়েদিদের আসা বারণ। পোর্ট ব্লেয়ারে যাতে প্লেগ বা অন্য কোনো ছোঁয়াচে অসুখ না ঢোকে তার জন্য এই ব্যবস্থা। কয়েদিদের এখানে পায়ে বাড়ি দিয়ে রাখা হত এবং মাঝে মাঝে ঘাস কাটা, রাস্তা সাফ করা – এরকম কিছু কাজ করানো হত।
কোয়ারেন্টাইনে চোদ্দদিন আটকে রেখে এরপর তাদের গোরুর পালের মতো তাড়িয়ে নিয়ে আসা হত সেলুলার জেলে। ‘বিছানা পত্রের মোট ঘাড়ে কুব্জপৃষ্ঠ নুব্জদেহ এই নতুন দল ঝমর ঝম্ ঝমর ঝম্ মল বাজাইয়া ভয়ে জুল জুল করিয়া চাহিতে চাহিতে সারি সারি আসে।’ সামনে পেছনে আশে পাশে লাল পাগড়ি ওয়ার্ডারের দল “এই ইধার”, “সিধা চলো”, “বৈঠ যাও”, “সরকার” – এইসব আওয়াজ দিতে দিতে লাঠিহাতে তাড়িয়ে নিয়ে আসে। তারপর পায়ের বেড়ি কাটা হয় এবং কয়েদিদের জন্য নির্দিষ্ট পোশাক পরতে দেওয়া হয়। পরদিন জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট মারে সাহেব প্রত্যেকের ডাক্তারি পরীক্ষা করেন। এরপর জেলার ব্যারী সাহেব তাদের কাম বাটেন।
ব্যারী সাহেব প্রকাণ্ড ভুঁড়ি নিয়ে মোটা বর্মা চুরুট মুখে গুঁজে, লাঠি বগলে সারি বাঁধা কয়েদিদের ফাইলের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে প্রত্যেক কয়েদির গলায় ঝোলানো টিকিটের ওপর লিখতে থাকেন – “ছে মাহিনা কোঠলি বন্ধ”, “দো পাউন্ড ছিলকা কুটো”, “এক সাল জেল বন্ধ, হাঁথ কলু পিষো”, “দো সাল জেল বন্ধ, ছে মাহিনা কোঠলি বন্ধ, সাব্বল চালাও”, “ছে মাহিনা জেল বন্ধ, তিন পাউন্ড রসসি বাটো”, “ছে মাহিনা জেল বন্ধ, পানিওয়ালা তিন নম্বর” ইত্যাদি। যাদের কলুতে জোতা হল তাদের সাড়ে সর্বনাশা দিনযাপন শুরু হল, যারা ছিলকা কোটার কাজে নিযুক্ত হল তাদের অবস্থাও তথৈবচ। বাকিদের কাজ তো সেই তুলনায় রাজকীয়।
ছয়মাস বা একবছর সাজা খেটে একদিন এরা জেল থেকে ছাড়পত্র পেয়ে বাইরে আসে। জেলের পোশাক ছেড়ে আগেকার মতো বিছানাপত্র ঘাড়ে করে তারা জেল ফটকে টিন্ডালদের হাতে সমর্পিত হয়। এই টিন্ডালরা আগে থেকে কয়েদি খালাসের খবর পেয়ে চার-পাঁচজন পেটি-অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে অ্যাবারডিনে এসে পৌঁছায় খালাসের আগের দিন। এরপর ছাড়া পাওয়া কয়েদিদের নিয়ে “জোড়া জোড়া হো যাও”, “খাড়া হো যাও” এইসব হুকুম দিতে দিতে ভেড়ার পালের মতো তাদের নিয়ে ফিরে যায় এক একটি কাজের জায়গায়, যাকে স্থানীয় ভাষায় ‘টাপু’ বলা হয়। এক একজন টিন্ডালের সঙ্গে দশ-বারোজনের এক একটি কয়েদির দল মোট ঘাড়ে করে এক একটা টাপুতে চলে যায়।
আরও পড়ুন
এক নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড
আন্দামানের পুর্ব জেলার অ্যাবারডিনে কাজ ছিল রাস্তাঘাট তৈরি, ইঞ্জিনিয়ারিং গুদাম, নারকেল ফাইল, জেটিতে জাহাজে মাল বোঝাই ও খালাসের কাজ, পাথর ভাঙা ও ঝাড়ু দেওয়া। ফিনিক্স বে-তে বড়ো সরকারি কারখানা। সেখানে লোহা, পিতল, ঝিনুক, কচ্ছপের হাড় ও কাঠ থেকে নানা শিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদন করা হত। তিন-চারশো লোক কাজ করত। তাছাড়া এখানে রাস্তা তৈরি করা, পাথর ভাঙা, নারকেল ফাইল, জল বওয়া, ঝাড়ু দেওয়া – এসব কাজ তো আছেই। মিডল পয়েন্টের নাম ছিল ‘ছোলদারি’ (কয়েদিদের রাখা নাম)। এখানে সাধারণ টাপুর নিত্যনৈমিত্তিক কাজ ছাড়াও ছিল হাড্ডু বাগান এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইলের কাজ। তাছাড়া এখানে একটা বড়ো হাসপাতালের কাজেও কাউকে কাউকে নিযুক্ত করা হত। নেভি বে টাপুতে বড়ো বড়ো শাক-সবজির বাগান ও ফলের বাগানে কাজ করার পাশাপাশি থাকত সমুদ্রের বাঁধ মেরামতির কাজ। কিছু কয়েদিকে পাঠানো হত জঙ্গলে বাঁশ-বেত কাটতে।
আন্দামানের পশ্চিম জেলায় টাপুগুলি ছিল চ্যাথাম, শোর পয়েন্ট, ডান্ডাস পয়েন্ট, ভাইপার, উইম্বারলিগঞ্জ, কালাটাঙ ও বারাটাঙ-এ। চ্যাথাম প্রসিদ্ধ ছিল কাঠ চেরাই কারখানার (স-মিল) জন্য। এখানে সমস্ত আন্দামানি বনবিভাগের কাঠ মেশিনে কেটে তক্তা, বাটাম, কড়ি ও বরগা তৈরি হত। শোর পয়েন্টে মাছের ফাইল, নারকেল ফাইল ও ইঞ্জিনিয়ারিং গুদাম ছিল। ডান্ডাস পয়েন্ট ইটের পাঁজা ও কারখানার জন্য বিখ্যাত ছিল। ভাইপার ছিল সেই সময় পশ্চিম জেলার সদর। সেখানে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত ও বাংলো। এখানকার প্রধান কাজ শাক-সবজির বাগান, জেটি ফাইল, খেলার মাঠ ও সাহেবদের বাংলো ও বাগান পরিষ্কার, বেত ও বাঁশ কাটা, ঝাড়ু দেওয়া, আবর্জনা সাফাই এবং অফিস-আদালত-হাসপাতালের কাজ। উইম্বারলিগঞ্জে দইঘর ও কাঠ চেরা ফাইলের কাজ। এরপর বারাটাঙ পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করা তখন ছিল এক ভয়ানক কাজ। বারাটাঙ-এর আগে কালাটাঙ ঘোর জঙ্গল। এখান থেকে জারোয়া অধ্যুষিত এলাকা বারাটাঙ পর্যন্ত বিস্তৃত। কার যে কখন জারোয়াদের তিরের পাল্লায় পড়ে প্রাণ যায় সেটাই ছিল জীবন-মরণের প্রশ্ন। এখানে আবার বিখ্যাত যমরাজতুল্য মিন্টো সাহেবের চা-বাগান। কয়েদিরা যারা এখানে কাজ করতে আসে তারাই ছিল সবথেকে অসহায়। জারোয়া আর মিন্টো সাহেবের মাঝখানে পড়ে তাদের প্রাণ যায় যায় অবস্থা।
আরও পড়ুন
জারোয়াদের কথা, দুধনাথ তিওয়ারি এবং অ্যাবারডিনের যুদ্ধ
প্রত্যেকটি টাপুতে ষাট-সত্তরজন কয়েদির থাকার ব্যবস্থা। তারা থাকে ব্যারাকে। ব্যারাকগুলি কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি, ছাদে টালি, মেঝেতে কাঠের তক্তা পাতা। এই ব্যারাকগুলিতে তিনটি সারি দিয়ে বিছানা পাতা থাকে। এক একটা টাপুতে একজন জমাদারের অধীনে চার-পাঁচজন টিন্ডাল থাকে। আবার এই টিন্ডালদের অধীনে থাকে বিশ-পঁচিশজন পেটি অফিসার। প্রত্যেক ব্যারাকে দুটো করে আলো থাকে। ব্যারাক বন্ধ হয় রাত আটটায়। তখন কয়েদিদের বিছানায় বসে একবার গুনতি দিতে হয়। এরপর আর কেউ বাইরে যেতে পারে না। সারা রাত তাদের পাহারা দেয় জমাদার ও পেটি অফিসাররা। পরদিন সকালে হয় আরেক প্রস্থ গুনতি। এখানে গুনতির মজাটা এই যে সমস্ত গুনতি হয় জোড়ায় জোড়ায়। কোনো কারণে গোণার সময় যদি কেউ বেজোড় হয়ে যায় তাহলে ‘রাম দো তিন’ করে যে গুনতি শুরু হয়েছিল তা ঘেঁটে গিয়ে একা বিজোড় ব্যক্তির ওপর কিল-চড়-ঘুষি নেমে আসে এবং কাউকে না কাউকে তার সঙ্গে জুটিয়ে জোড়া বেঁধে পুনরায় নতুন করে গুনতি শুরু হয়।
সকালে উঠে আবার গোনার পালা। “আপনা আপনা বিস্তারা মে বৈঠ যাও।” এরপর ভেড়া গোনার মতো একপ্রস্থ গুনতি শেষে সবাই শৌচকর্ম ও হাত-মুখ ধোবার অনুমতি পায়। জলের জন্য একটা করে জলের পিঁপেতে মিষ্টি পানীয় জল থাকে। সেগুলিতে সারাদিন ধরে পানিওয়ালারা জল ভরে রাখে। সেই জল প্রত্যেককে তাদের নিজস্ব লোহার বাটিতে একটা ছোট টিনের মগে করে দেওয়া হয়। সেই জল দিয়ে তাদের হাত-মুখ ধুতে হয়। এরপর “জোড়া জোড়া হো যাও” নির্দেশে সবাই যে যার মতো একজনের সঙ্গে জোড় বেঁধে বসে পড়ে।
আরও পড়ুন
পাইরেটস অফ আন্দামান – নিকোবর আইল্যান্ডের গল্প
এবার গুনতি ঠিকঠাক হলে পরে সেদিনের জন্য কাজ বাটা হয়। বাগানের কাজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইল প্রভৃতি বিভিন্ন ফাইলে কয়েদিদের বাটার কাজ শেষ হলে যারা তাদের নিতে আসে সেই সমস্ত ‘জবাবদার’রা নিজেদের লোক বুঝে নিয়ে বগলদাবা করে কর্মক্ষেত্রে রওনা দেয়। সকাল দশটা পর্যন্ত কাজ চলে। তারপর জবাবদাররা হাঁকডাক করে যে যার দল বুঝে নিয়ে গিয়ে টাপুতে ফের গুনতি করে জমাদারের হাতে সমর্পণ করে। এবার স্নান-আহার ও বেলা একটা পর্যন্ত বিশ্রাম। তারপর আবার জবাবদাররা এসে হাজির হয়, যে যার টিন্ডাল ও পেটি অফিসারের অধীনে দল বাঁধে ও কাজের জন্য পুনর্যাত্রা করে। বিকেল পাঁচটায় ছুটি হলে যে যার টাপুতে ফিরে আসে। সন্ধ্যার আগেই রাত্রিকালীন আহারের জন্য সবাই থালা-বাটি পেতে সার দিয়ে বসে যায়। খাওয়া শেষ হলে নিজেদের মধ্যে গল্প-গুজব, টাপুর কাছে ঘোরাফেরা, লুকিয়ে লুকিয়ে নেশাভাঙ করা। এরপর রাত আটটার আগে যে যার ব্যারাকে গুনতি ও শোবার জন্য হাজিরা দেওয়া – এই ছিল প্রাত্যহিক রুটিন। শুধুমাত্র রবিবার সকালে টাপুর আশপাশ পরিস্কার করা ও নিজের জামাকাপড় ধোয়া ছাড়া তেমন কোনো কাজ থাকত না। সেদিন ছুটির দিন। এইদিন জমাদার বা অন্য যে কোনো হুকুমদারকে ভুলিয়ে ভালিয়ে অন্য টাপুতে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা মেরেও আসা যেত।
এই ছিল আন্দামানে পেনাল সেটেলমেন্টে সাধারণ বন্দিদের রোজনামচা।
আরও পড়ুন
আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে দ্বিতীয় বন্দি-উপনিবেশ ও কয়েদিদের জীবন
Powered by Froala Editor