দুর্ধর্ষ দুশমন - ২৩
আগের পর্বে
১৯৫৯ সালের ১৩ নভেম্বর। সূর্য ওঠার আগেই থানায় এসে হাজির হয়েছিল গব্বরের খবরাখবর। সেই মতো প্ল্যান তৈরি করে মোদির ঐতিহাসিক মুঠভেড়। তিন দিক থেকে পুলিশ ঘিরে ফেলে গব্বরের ১১ জন সদস্যের দলকে। সকাল থেকে সন্ধে অবধি চলে গুলির লড়াই। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে যাতে পালাতে না পারে ডাকাতরা, সেজন্য শেষ অবধি নিজেই রণে অবতীর্ণ হন মোদি। তার ছোঁড়া হ্যান্ড গ্রেনেডেই নিশ্চিহ্ন হয় গব্বরের দল। চোয়াল উড়ে গিয়েছিল গব্বরের। গব্বরের মৃত্যুতে উৎসব নামে চম্বলের পথে পথে। সেদিনের সেই মুঠভেরে পুলিশের উর্দিতে উপস্থিত ছিলেন ফিল্ম রাইটার সেলিম খানের বাবা আব্দুল রশিদ খানও। সেখান থেকেই গব্বর ঢুকে পড়েছিল বলিউডের গল্পে। শোলে সিনেমার পর চম্বলের আরও এক ডাকাত প্রীতম সিং-ও নিজের না বদলে রেখেছিল গব্বর। তারপর...
পরদিন ঘুম থেকে উঠেই চললাম মোহর সিংয়ের ডেরায়। ভিণ্ড বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে চড়ে মেহেগাঁও পৌঁছে নাম বলতেই পৌঁছে যাই তাঁর বাড়ি। একসময়ের চম্বলের সবচেয়ে বড়ো গ্যাং-এর সর্দার। যার দলে ছিল প্রায় ৫০০জন ডাকাত। দস্যু সুন্দরী ফুলন দেবী প্রথম বেহড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে যার কাছে শিখতে এসেছিলেন বন্ধুক চালাতে। যার দলে যোগ দেওয়া ছিল এক অন্য সম্মানের ব্যাপার। মান সিংয়ের পর চম্বলের সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ডাকাত। আজ যিনি পুরো মেহেগাঁওতে পরিচিত বাগীভাই বলে। প্রতি সন্ধ্যায় সৎসঙ্গ-এ বাগীভাইয়ের গান শুনতে আজও ভিড় জমে যায়। প্রতিদিন কীর্তন আর ভজন গান ৮৮ বছরের তরুণ মোহর সিং। তাঁর আত্মসমর্পণের কাহিনিও কম রোমাঞ্চকর নয়।
শুধু যে ডাকাত ছিলেন মোহর সিং, তা নয়। তিনি ছিলেন মেহগাঁও মিউনিসিপ্যালিটির দুবারের চেয়ারম্যান। ১৯৯৫-তে তিনি প্রথম রাজনীতিতে আসার কথা ভাবেন। সেই বছর বিজেপি-সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়ান। শুধু দাঁড়ানোই নয় বিপুল ভোটে জয়ীও হন। ১৯৯৬ সালে যোগ দেন বিজেপিতে। সে-বছরই দ্বিতীয়বার ভোটে জিতে মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান হন। যেমন-তেমন চেয়ারম্যান নন, একেবারে সৎ চেয়ারম্যান। আজও তার চেয়ারম্যান হওয়ার সাক্ষ্য বহন করছে, মেহেগাঁওয়ের জল-ট্যাঙ্ক। যেখানে আমি বাস থেকে নেমেছিলাম। আজ মেহেগাঁওতে এত পাকা রাস্তা, নিকাশিব্যবস্থা, স্কুল-কলেজ। এই ঝকঝকে মেহেগাঁও শহর আগে এরকম ছিল না। আধুনিক মেহেগাঁওয়ের রূপকার প্রবাদপ্রতিম ডাকাত মোহর সিং। ঘণ্টা দুয়েক আড্ডা দিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে। তার মধ্যেই একটা ছেলে ছুটে এসে কী যেন কানে কানে বলে মোহরকে। মুহুর্তে চোখ দুটো লাল হয়ে ওঠে তার। একবার আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘অউর কুছ পুছনা হ্যায় তো জলদি বোলো, মুঝে জানা হ্যায়। ভোলু বন্দুক নিকালো। গোলি ডালো উসমে।’ মোহরের বড়ো নাতি ভোলু।
আমি দ্রুত প্রশ্ন করতে শুরু করি। এর মধ্যে একটা ডবল-ব্যারেল বন্দুক নিয়ে আসে ভোলু। খাটিয়ায় বসে তাতে গুলি ভরার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। শেষে তাকে ধমকে ওঠেন মোহর সিং। ‘বেহেনচোদ, বারহ সাল উমর হো গয়ী, আভি তক গোলি ডালনা তো দূর বন্দুক পকড়না নেহি আতা! বেশরম কাহিঁকা, কাঁহা সে প্যায়দা হো গয়া মেরে ভন্শ মে। আরে উস চুতিয়েকো থোড়া দিখা দে’। খবর দিতে আসা ছেলেটার (মোহরের ছোটোছেলে) উদ্দেশে মোহর কথাগুলো বলেন।
তারপর খাটিয়া থেকে হয়ে উঠে দাঁড়ান পঁচাশি বছরের টানটান মোহর সিং। দেখে কে বলবে তখন, কিছুক্ষণ আগেই লাঠি নিয়ে হাঁটছিলেন মোহর! হাতের লাঠিটা ছুড়ে ফেলেন। আমাকে বললেন, ‘দশ মিনিটে ইন্টারভিউ শেষ করো, ফির মুঝে যানা হ্যায়।’ পায়চারি করতে করতে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে থাকেন অস্থির মোহর। এক সময় আমার দিকে হাত তুলে থামালেন। তারপর বললেন, ‘ব্যস হো গয়ী, বাদমে কভি আনা, তুমহারা টাইম খতম’ বলেই গেটের সামনে এসে দাঁড়ানো গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। আর গাড়ি ছুটে চলল মোহর সিং-এর দুশমনের দিকে। আজ আর তার রক্ষে নেই। নাহ এভাবে বললে গল্প জমবে না। আগে আমার আর মোহরের সেদিনের কথোপকথনের খানিকটা হুবহু তুলে দিই তারপর একদম প্রথম থেকে তাঁর গল্প আর আমার তার মুখোমুখি হওয়ার কাহিনি বলা যাবে।
প্র: আপনি কি এখন আর আপনার অপরাধের জন্য অনুতপ্ত?
প্র: আত্মসমর্পণের পর সরকারের তরফ থেকে কিছু পেয়েছিলেন?
উ: আমাকে জমি দেওয়া হয়েছিল পনেরো একর।
প্র: পুরোনো শত্রুদের সঙ্গে দেখা হয় এখনো?
উ: হ্যাঁ, হয়। রাজারাম আসে কখনো কখনো। এখন সবাই আমাকে সম্মান করে। ভালোবাসে। মহল্লায় সবাই আমাকে বাগীভাই বলে ডাকে।
প্র: অন্যান্য দলের সঙ্গে আপনাদের ঝামেলা বাঁধত বাগী থাকার সময়?
উ: নাহ্, সেটা কখনো হত না। বেহড়ে চলার সময় আমাদের দেখা হত, কথাবার্তা হত। হালচাল পুঁছতে থে, ব্যস্।
প্র: ফুলনকে মারল কারা?
উ: ওর শত্রুরাই ওকে মেরেছে।
প্র: রাজনীতিতে আপনার পরিকল্পনা কী?
উ: কোনো পরিকল্পনা নেই। দ্যাখো ভাই, আমি এটা খুব ভালো করে বুঝে গেছি চম্বলের থেকেও অনেক বড়ো বড়ো ডাকাত আছে রাজনীতিতে। যাদের অপরাধ চম্বলের ডাকাতদের থেকেও অনেক বেশি। রাজনীতিতে আমার মোহভঙ্গ হয়েছে। আমি যতদিন ছিলাম মানুষের সেবা করতে চেয়েছি, করেছিও।
প্র: এখন আপনি কোন দলকে সমর্থন করেন?
উ: সমর্থন কিনা জানি না, তবে এখন আমি ভোট দিই কংগ্রেসকে।
প্র: আপনারা বাগী থাকার সময় অস্ত্রশস্ত্র কোথা থেকে পেতেন?
উ: ইয়ে তো নেহি বাতায়েঙ্গে। এই প্রশ্নের জবাব আমি কোনোদিন কাউকে দিইনি, আর দেবোও না কখনো।
প্র: জীবনে আর কিছু পাওয়ার বাকি আছে আপনার?
উ: জীবনে অনেক হারিয়েছি, পেয়েছিও অনেক। সম্প্রতি ট্র্যাক্টর কিনেছি। চম্বলমে সম্মান সে রেহেনেকে লিয়ে তিন চিজ হোনা জরুরি হ্যায়। অউর ওহ তিনো চিজ হ্যায় মেরে পাস। রাইফেল, ট্র্যাক্টর অউর লম্বী মুছে।
Powered by Froala Editor