ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলি তো বটেই, কোভিড ১৯ অতিমারী যে পৃথিবীর প্রথম সারির দেশের স্বাস্থ্যপরিষেবাকেও এক অপরিসীম সংকটের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে, এ কথা এখন প্রমাণিত সত্য। ভারতের বুকে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় তরঙ্গ আছড়ে পড়ায় আমরা যে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবামূলক সংকটের সম্মুখীন হয়েছি, তার মধ্যে অক্সিজেন সংকট ও হাসপাতালের পরিকাঠামো জনিত সমস্যা অবশ্যই অন্যতম। কিন্তু এ দুটি ছাড়াও, ডায়াগনিসিস বা রোগ মূল্যায়নের পদ্ধতিগত আরো একটি সমস্যা নিয়ে সংবাদ মাধ্যম বা সোশাল মিডিয়ায় কথা প্রায় হয় না বললেই চলে। এর কারণ, এই সমস্যাগুলো শেষ অবধি রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতিকে নিয়ন্ত্রণ করলেও, অক্সিজেনের অভাব বা হাসপাতালে জায়গা না পাওয়ার সংকটের মতো মানুষের জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করে না। বর্তমান আলোচনার বিষয়বস্তু তেমনই এক সমস্যা - ‘কোভিড মূল্যায়নে ফুসফুসের চিত্রকরণ বা ইমেজিং-এর প্রয়োজনীয়তা, ভারতে তার উপলব্ধ পদ্ধতির সমস্যা এবং একটি লভ্য ও সুপরিচিত সমান্তরাল সমাধান’।
ফুসফুসের ছবি বা ইমেজিং প্রয়োজনীয়তা কোথায়?
কোভিড আক্রান্তের ক্ষেত্রে ফুসফুস জনিত যে মুল সমস্যাটি হয় ডাক্তার-বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছেন ‘ইন্টারস্টিশিয়াল লাং ডিসর্ডার’। প্রথমেই বোঝা দরকার, এই সমস্যা কিন্তু শুধুমাত্র কোভিড ১৯-এর সঙ্গেই সম্পর্কিত নয়। অন্যান্য পূর্বপরিচিত ভাইরাস বা ব্যাকটিরিয়া জনিত সংক্রমণ, বিষাক্ত ধুলো-ময়লা বা এ্যাসবেস্টসের কারণেও এ-সমস্যা হতে পারে। কিন্তু কোভিড ১৯ বৈজ্ঞানিক জগতের কাছে এখনও বেশ খানিকটা অপরিচিত হওয়ার কারণে, রোগের প্রাকৃতিক ধারায় কোন সময়ে এবং কী কারণে এই সমস্যার উদ্ভব সম্ভব তা সঠিক করে বলা বেশ কঠিন। খুব সহজ করে বলতে গেলে, এই ধরণের সমস্যায় দুই ফুসফুসের প্রধান কাঠামোকে (যাকে আমরা ইন্টারস্টিশাম বলে চিনি )ভিত্তি করে একধরণের প্রগতিশীল ফাইব্রয়েড বা স্কার (ক্ষতচিহ্নের মতো) সৃষ্টি হয়, যা ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ঠিক সময় এর অগ্রগতি আটকাতে না পারলে ফুসফুসের মৃত্যু ঘটতে পারে অথবা সংক্রমিত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে গেলেও চিরজীবনের মতো ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। কাজেই কোভিডের ক্ষেত্রে নিশ্বাসের অসুবিধা শুরু হলে ঠিক কেন প্রতি পদক্ষেপে ফুসফুসের ইমেজিং বা মূল্যায়ন এতটা জরুরি, তা বেশ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
ফুসফুস ইমেজিং-এর উপলব্ধ উপায় - সিটি স্ক্যান (CT Scan) বনাম লাং আলট্রাসাউন্ড (LUS)
আরও পড়ুন
সংক্রমণ-পরবর্তী ৫-১০ দিনকে বিশেষ গুরুত্ব দিন, পরামর্শ চিকিৎসকদের
এ কথা সত্যি যে ভাইরাস জনিত সমস্যার ক্ষেত্রে ফুসফুস ইমেজিং-এ ডাক্তাররা ঐতিহাসিকভাবে সিটি স্ক্যানের উপর ভরসা করে এসেছেন। সি-টি, অর্থাৎ কম্পিউটেড টোমোগ্রাফির অর্থ, বিভিন্ন দিক থেকে একটি প্রত্যঙ্গের ছবি তুলে, তার পরে কম্পিউটার এ্যালগোরিদম বা সফটওয়ারের সাহায্যে সেই ছবিগুলিকে একত্রিত করে একটি নির্দিষ্ট ফর্ম বা গঠন দেওয়া। প্রচলিত সিটি স্ক্যানের ক্ষেত্রে এই ছবি তোলার কাজটা করা হয় এক্স-রে বিকিরণের সাহায্যে। পাঠক একটু খেয়াল করলেই দেখবেন সিটি স্ক্যানের যন্ত্র মূলত এমআরআই-এর মতোই একটা টানেলের মতো দেখতে। সেই টানেলের মধ্যে রুগীকে শুইয়ে তার চারধারের বৃত্তের মধ্যে অন্তর্নিহিত এক্স-রে মেশিন দিয়ে নানান দিক থেকে ছবি তোলার কাজটা করা হয়। কোভিড ১৯ অতিমারীর শুরু দিন থেকেই, দেশ বিদেশের নানান স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিক পত্রপত্রিকায় একথা স্পষ্ট করে বলাও হয় যে সংক্রমণ জনিত ফুসফুসের সমস্যার সাময়িক বিবর্তন মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সিটিস্ক্যান এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে। তা সত্ত্বেও আমেরিকান স্কুল অফ রেডিয়োলজি ২২ মার্চ ২০২০ সালে তাদের রিপোর্টে জানান যে হাসপাতালে ভর্তি করোনা আক্রান্ত রুগীদের উপর সিটি স্ক্যানের ব্যবহার সীমিত করতে হবে। এই সুপারিশের দুটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে –
আরও পড়ুন
‘আইভারমেকটিন’ ম্যাজিক ড্রাগ নয়, ডেকে আনতে পারে বিপদও; জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা
১) সিটি স্ক্যান প্রয়োগ করার যা পদ্ধতি, তাতে, সিম্পটোম্যাটিক রোগীদের সংস্পর্শে আসার ফলে মেডিকাল স্টাফ এবং তারপর অন্যান্য অ-কোভিড রোগীদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
আরও পড়ুন
রেমডিসিভির মানেই করোনা-জয় নয়, জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা
২) সিটি স্ক্যানে্র ক্ষেত্রে এক্স-রে রেডিয়েশান বা বিকিরণের আনুমানিক মান একটা সাধারণ এক্স রে স্ক্যানের তুলনায় প্রায় ২০-৩০ গুণ। সেক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণ বিতাড়িত হলেও অদূর ভবিষ্যতে রোগীর ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
এছাড়াও এক্স-রে সি-টি বেশ খরচা সাপেক্ষ একটি মূল্যায়ন পদ্ধতি।
তবে উপায়?
উপায় একটা আছে বৈকি! সে কথাই বলতে বসা। মেডিকাল ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা তার নাম দিয়েছি POCUS অথবা পয়েন্ট অফ কেয়ার আলট্রাসাউন্ড। আমরা সকলেই হাসপাতাল বা পলিক্লিনিকে হওয়া আলট্রাসোনোগ্রাফির সঙ্গে পরিচিত। POCUS-এর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই। তবে এই ক্ষেত্রে রোগীকে সিটি বা প্রচলিত আলট্রাসাউন্ডের মতো একটি নির্দিষ্ট কক্ষে বা পলিক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। উপরন্তু বিশেষভাবে নির্মিত প্রযুক্তি ও পোর্টেবল যন্ত্রের মাধ্যমে রোগী যে ঘরে বা অবস্থায় রয়েছেন সেখানেই এই মূল্যায়ন করা সম্ভব। যে কোনো রকম বিকিরণ ভিত্তিক পদ্ধতির (এক্স রে, এক্সরে-সিটি, রেডিওগ্রাফি, ইত্যাদি) তুলণায় আলট্রাসাউন্ড ইমেজিং পদ্ধতির ক্ষেত্রে একটা বিশেষ সুবিধা হল, আমরা এই ক্ষেত্রে সাবমেরিন যে ভাবে জলের তলায় ‘SONAR’ ব্যবহার করে শত্রু যুদ্ধজাহাজ খুঁজে বের করে ঠিক সেইভাবে শব্দ এবং তার কম্পনকে ছবি তৈরির কাজে ব্যবহার করে থাকি।
কাজেই এই পদ্ধতিতে রেডিয়েশান বা বিকিরণগত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার অসুবিধাটা থাকছে না।
এছাড়া বিগত ২ দশকে ভাইরাস জনিত একের পর এক অতিমারীর ক্ষেত্রেও এই POCUS-এর ব্যবহারের যথেষ্ট প্রমাণ আমরা পাই। যেমন ২০০৯ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা-A অতিমারীর ক্ষেত্রে দ্রুত ছড়িয়ে পরা ইন্টারস্টিশিয়াল লাং ডিসর্ডার মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সিটির তুলনায় POCUS অনেক বেশি কার্যকরী ছিল। এমনকি ২০১৩, ২০১৪ এবং ২০১৬ সালে চায়নায় ধারাবাহিকভাবে আছড়ে পড়া এইচ৭এন৯ ভাইরাল সংক্রমণের ক্ষেত্রেও (৪০% মৃত্যুর হার) “সিরিয়াল লাং আলট্রাসাউন্ড” অন্যান্য বিকিরণগত পদ্ধতির থেকে অনেক বেশি উপযোগী ছিল। কাজেই বেশ বোঝা যাচ্ছে যে ঐতিহাসিকভাবেই এই ধরনের এইচ-এন ভাইরাল স্ট্রেইনের ক্ষেত্রে পোকাস এক বিকিরণগত-পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিহীন ফলপ্রসূ মূল্যায়ন পদ্ধতি।
তাছাড়া প্রচলিত আলট্রাসাউন্ড ইউনিটের তুলনায় POCUS যন্ত্রের দাম প্রায় ১৫-৭৫ গুণ কম হতে পারে। অন্যদিকে, আকারে ছোটো হওয়ায় এই ধরণের যন্ত্র স্যানিটাইজ বা স্টেরিলাইজ করাও সিটি বা অন্যান্য বড়ো যন্ত্রের তুলনায় অনেকটাই সহজ।
GE Healthcare কোম্পানির চিফ মেডিকাল অফিসার মাথিয়াস গোয়েন যেমন জানাচ্ছেন, “সাধারণ নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রেও সিটির তুলনায় প্রচলিত আলট্রাসাউন্ডের কিছু নিজস্ব সুবিধা রয়েছে। আদর্শ পরিস্থিতিতে কোভিড ১৯-এর ক্ষেত্রে সি-টি অবশ্যই আদর্শ পদ্ধতি, কিন্তু এইসময়ে দাঁড়িয়ে যেহেতু পরিকাঠামোগত ব্যবস্থা অনেকটাই হাতের বাইরে, সেখানে আইসিউতে ভর্তি রোগীর প্রয়োজনীয় পয়েন্ট অফ কেয়ার চিকিৎসার ক্ষেত্রে আলট্রাসাউন্ডের ব্যবহার অবশ্যই হাতের কাছেই সহজলভ্য এক পদ্ধতি।” এখানে মনে রাখা দরকার জি-ই হেলথকেয়ার কিন্তু উভয় মেশিনই তৈরি ও বিক্রি করে থাকে, কাজেই সেক্ষেত্রে মুনাফার কথাটা এখানে উঠছে না।
ভারতের বাজার ও কোভিডে সিটি-স্ক্যান ব্যবহা্রের প্রবণতা
ভারত এক উন্নয়নশীল দেশ বা থার্ড ওয়ার্ল্ডের অন্তর্ভুক্ত বলে যে এই আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে আমাদের নাগরিকরা পুরোপুরি ব্রাত্য, এমনটা ভেবে নেওয়ার কোনো কারণই নেই। উপরন্তু আলট্রাসাউন্ড ইমেজিং বাজারের সর্ব বৃহৎ কোম্পানিগুলির যন্ত্র (প্রোব) তৈরির কারখানা বা প্রডাকশান ইউনিট খোদ ব্যাঙ্গালোরেই রয়েছে। তাছাড়া কোভিড সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই সারা বিশ্ব জুড়ে এই ধরণের প্রোবের বাজার-চাহিদা প্রায় ৪ গুণ বেড়ে গিয়েছে । আমাদের উপমহাদেশ যে সেই বাজারের একটা বিরাট শতাংশের অংশীদার সে কথা যে-কোনো সুবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই বুঝবেন। এ-কথা সত্যি যে সি-টি একটি পূর্বপ্রচলিত পদ্ধতি এবং অনেক জায়গাতেই তা নতুন প্রযুক্তির তুলনায় সহজলভ্য, কিন্তু সেক্ষত্রে তো প্রচলিত আলট্রাসাউন্ডও সহজেই হাতের নাগালে পাওয়া যেতে পারে, তাই নয় কি? অন্যদিকে অত্যাধুনিক শহুরে প্রতিষ্ঠান, যেখানে POCUS-এর সহজলভ্যতা বিরাট কোনো সমস্যাই নয়, সেখানেও কোভিডে ফুসফুস মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মূলত সি-টি ব্যবহারের মূলে রয়েছে আমাদের দেশের হাতেগোনা কিছু মুনাফালোভী সংগঠন এবং ব্যক্তিগত লাভের লোভে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই চক্রবূহ রচনা করে চলা বেশ কিছু ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এই অভাবনীয় ভয়াবহতার দিনে, যেখানে মানুষের প্রাণটুকু তাদেরই দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভরশীল, সে সময়ে আর্থিক মুনাফার কথা কিছুদিনের জন্য ভুলে তারা বর্তমান সমস্যা এবং সংক্রমিত রোগীর ভবিষ্যৎ সুস্থতার কথা ভেবে সঠিক মূল্যায়ন পদ্ধতিটুকু বেছে নিন, এটুকুই প্রাবন্ধিকের আন্তরিক আকুতি।
(লেখক জি-ই-হেলথকেয়ারের প্রোব শাখায় বিজ্ঞানী হিসাবে কর্মরত। লেখকের বক্তব্য তাঁর ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor