মিলনেচ্ছু যমী বদলে গেলেন ‘ভগিনী’ যমুনায়, যমের দৃঢ়তাই কারণ?

ভাইফোঁটা এলেই সেই লোককথা মনে পড়ে, যমুনা যমের কপালে এঁকে দিচ্ছেন ফোঁটা, আর তাঁরই অনুসরণে মর্ত্যভুবনের বোনেরাও ভাইদের দীর্ঘায়ুকামনায় ললাটে আঁকছেন চন্দনতিলক। মৃত্যুকে প্রতিহত, কিংবা বিলম্বিত করার এই যে সামূহিক প্রয়াস— এ কি শুধুই লোকাচার? উঁহু, শাস্ত্র তো তা বলছে না। তবে? আসুন, একটু পুঁথিপত্র ঘেঁটে দেখা যাক।

যম ও যমী— এই দুই ভাইবোনের প্রাচীনতম উল্লেখ মেলে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম সূক্তে। সেখানে দেখি, সহোদর এমনকী সমগর্ভজাত যমকে শয্যাসঙ্গী হবার জন্য যমীর বারংবার আহ্বান, এবং যমের স্পষ্ট ও পুনরাবৃত্ত প্রত্যাখ্যান। সমাজতাত্ত্বিক বলবেন, এ হল আদিম বা প্রিমিটিভ মানবগোষ্ঠীর সংস্কার-বোধহীন যথেচ্ছ মৈথুন-স্বভাব থেকে সরে এসে, সংস্কারবদ্ধ সমাজ তথা পরিবারের অভিমুখী যাত্রা। যমী এখানে আদিম অ-সভ্য অ-নিয়মের প্রতিভূ, আর যম সভ্যতা-সংশ্লিষ্ট নিয়মের প্রতিনিধি। 

পরবর্তী সাহিত্যে, বিশেষত পুরাণেতিহাসে, যম-যমীর এই ইরোটিক টেনশনের গল্প আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু, পাওয়া যাবে, যম মানে যেমন পুরাণের মৃত্যু-নিয়ামক দেবতাবিশেষ, তেমনই যম মানে আত্মনিয়ন্ত্রণ। সম্যকরূপে যম, সংযম। আর এই সংযম, পাশব প্রবৃত্তিকে নৈতিক বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ, এই হল সভ্যতার চিহ্ন, এরই নামান্তর ধর্ম। মনে রাখবেন, পুরাণে যমের অপর নাম ধর্মরাজ, যম হলেন মূর্তিমান ধর্ম।

পুরাণে যমী নেই, যমুনা আছেন। যম ও যমুনা, সূর্য ও বিশ্বকর্মা-পুত্রী সংজ্ঞার সন্তান। তাঁদের মধ্যে কোনো প্রবৃত্তিজ টানাপোড়েনের গল্প নেই। যমুনা স্পষ্টত দ্বারকাধীশ কৃষ্ণের চতুর্থী মহিষী। এই যম আর যমুনার ভ্রাতৃ-ভগিনী বন্ধনের উদযাপনই ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, চলতি কথায় ভাইফোঁটা, কিংবা ভাইদুজ। পদ্মপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণে পাওয়া যায় ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার বিধিনিয়ম। বাংলায় স্মার্ত রঘুনন্দন ষোড়শ শতকে যে 'কৃত্যতত্ত্ব' সংকলন করেন, তাতে 'ভ্রাতৃদ্বিতীয়া' শব্দের স্পষ্ট উল্লেখ আছে। সেদিনের যমপূজায় যমকে প্রণামের মন্ত্রে ‘নমস্তে যমুনাগ্রজ’ শব্দগুচ্ছের অবস্থান বুঝিয়ে দেয়, যম-যমুনার সোদর-সম্বন্ধের উদযাপনই এই উৎসবের হেতু।

ভাইফোঁটা কি কেবল হিন্দুদের উৎসব? উঁহু, একেবারেই না। ১৪২২ খ্রিস্টাব্দে জৈন আচার্য সর্বানন্দ সূরির লেখা 'দীপোৎসবকল্প' পুঁথিতে রয়েছে, অন্তিম তীর্থংকর মহাবীরের নির্বাণলাভ হলে রাজা নন্দীবর্ধন শোকমগ্ন হয়ে পড়েন। তখন রাজার বোন অনসূয়া রাজাকে সান্ত্বনা দেন, এবং আদর করে ভোজন করান। সেই থেকে জগতে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পর্বের সূচনা। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট ধর্মগোষ্ঠীর বেড়া ডিঙিয়ে এ হল ভারতীয় উপমহাদেশের এক সর্বজনীন পার্বণ।

তাই হয়তো, আধুনিক ধীমান বাঙালির গড়ে তোলা ব্রাহ্মসমাজে হিন্দুর বহু রীতিনীতি কুসংস্কার-বোধে ত্যক্ত হয়েছে, কিন্তু রয়ে গিয়েছে ভাইফোঁটা। রাণী চন্দের 'গুরুদেব' বইতে পাওয়া যাচ্ছে ১৯৪০ সালে রবীন্দ্রনাথের জীবনের অন্তিম ভাইফোঁটার কথা, যেদিন বৃদ্ধ ভাইয়ের কপালে ফোঁটা এঁকে দিয়েছিলেন অশীতিপর দিদি বর্ণকুমারী দেবী। এর আগে, ১৯৩৬ সালে, বরানগর-বাসিনী পারুল দেবীকে ভাইফোঁটার দিনই 'ভাইদ্বিতীয়া' নামে একখানি কবিতা লিখে স্নেহাশীষ পাঠান কবি। এ কবিতা পরে 'প্রবাসী' পত্রিকায় ছাপা হয়, ঠাঁই পায় 'প্রহাসিনী' বইয়ের পাতাতেও। কবি লিখছেন,

"...এল তিথি দ্বিতীয়া
ভাই গেল জিতিয়া
ধরিল পারুল দিদি
হাতা বেড়ি খুন্তি।
নিরামিষে আমিষে
রেঁধে গেল ঘামি সে,
ঝুড়ি ভ'রে জমা হল
ভোজ্য অগুন্তি।..."

আজ ভাইফোঁটা। বাংলাদেশের পাবনা-বিক্রমপুর হোক, কিংবা পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা-বাঁকুড়া-রাঢ়ভূমি, আজ বোনেরা ভাইদের দীর্ঘায়ু-কামনায় কপালে এঁকে দেবেন সুমঙ্গল চন্দনতিলক, সমস্বরে বলবেন, 

"ভায়ের কপালে দিলাম ফোঁটা
যমদুয়ারে পড়ল কাঁটা
কাঁটা যেন সরে না
ভাই যেন মরে না..."

ঋণস্বীকার: তন্ময় ভট্টাচার্য রচিত 'না যাইয়ো যমের দুয়ার'।

Powered by Froala Editor