মরুভূমির বুকেই বিরাট বনভূমি, চিনের বিজ্ঞানীদের কাণ্ডে অবাক সকলে

একদিকে ধু ধু করছে মরুভূমি। অন্যদিকে মানুষের বসতি। তাঁদের কৃষিজমি। অথচ দিনের পর দিন মরুভূমির সীমানা বেড়েই চলেছে। তাহলে উপায় কী? শেষ পর্যন্ত গড়ে উঠল এক বিরাট প্রাচীর। বিস্তীর্ণ সবুজ প্রাচীর আটকে দেবে মরুভূমিকেই। খোদ চিনের বুকেই গড়ে উঠেছে এমন এক মহাপ্রাচীর। চিনের বৈজ্ঞানিকরা যার নাম রেখেছেন সবুজ মহাপ্রাচীর। মরুভূমির বুকেও যে অরণ্য গড়ে তোলা সম্ভব, চিনের এই উদ্যোগ সেটাই প্রমাণ করল।

চিনের উত্তরাঞ্চলজুড়ে রয়েছে বিরাট গোবি মরুভূমি। এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বৃহৎ এই মরুভূমি শুষ্কতার দিক দিয়ে পৃথিবীর প্রথম সারির মরুভূমিগুলির একটি। গোবি মরুভূমি অঞ্চলে মানুষের বসতি বিশেষ নেই। কিন্তু মূলত মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত মরুভূমি থেকে ব্যাপক ধুলো উড়ে এসে জড়ো হয় দেশের মূল ভূখণ্ডেও। ধুলোর আস্তরণ ঢেকে ফেলে রাজধানী বেজিং শহরকেও। এমনকি চিনের দক্ষিণে লাওস, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে গোবি মরুভূমির ধুলো। এর ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন তো ব্যাহত হয়ই, সেইসঙ্গে কৃষিকাজেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। এইসমস্ত কারণের কথা মাথায় রেখেই ১৯৭৮ সালে তৈরি হয় একটি বিশেষ প্রকল্প। যার নাম ‘সবুজ মহাপ্রাচীর’। একসময় বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে চিনের মহাপ্রাচীর তৈরি হয়েছিল, আর এবারের মহাপ্রাচীরের নির্মাণ মরুভূমিকে ঠেকাতে।

প্রথমদিকে অবশ্য চিনের প্রকল্পের কথা শুনে অনেকেই হাসাহাসি করেছিলেন। কিন্তু সময় যত এগিয়েছে, ততই একটু একটু করে সাফল্যের মুখ দেখেছে এই প্রকল্প। ২০০৯ সালের মধ্যেই এর আয়তন দাঁড়ায় ৩০ মিলিয়ন একরের উপরে। তখনই বিশ্বের বৃহত্তম মনুষ্যসৃষ্ট অরণ্যের স্বীকৃতি পেয়ে যায় এই প্রাচীর। হেলিকপ্টার ও ড্রোনের সাহায্যে ব্যাপকভাবে গাছ লাগানোর প্রক্রিয়া তো চলল। কিন্তু মরুভূমির মধ্যে সেই গাছকে বাঁচিয়ে রাখা কি সম্ভব হবে? এই কাজেই সবচেয়ে বেশি অর্থ বরাদ্দ করে চিন সরকার। স্থানীয় কৃষকদের এই প্রকল্পে সামিল করার পাশাপাশি আশেপাশের স্কুলগুলির প্রোজেক্টের একটা বড়ো অংশ বরাদ্দ করা হয় এই বনভূমির পরিচর্যার কাজে। এখন রীতিমতো বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে মানুষের তৈরি এই জঙ্গল, এমনকি প্রতিদিন একটু একটু করে তার আয়তন বেড়েও চলেছে। ২০৫০ সালের মধ্যেই ৩ হাজার মাইল লম্বা এবং ৮৮ মিলিয়ন একর আয়তনের অরণ্য গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী চিনের বিজ্ঞানীরা।

তবে চিনের এই প্রকল্প শুনতে বেশ আশ্চর্য মনে হলেও এর পরিকল্পনায় বেশ কিছু ফাঁক থেকে গিয়েছে বলেই মনে করছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। প্রসঙ্গত, কয়েক বছর আগেই আফ্রিকার সাভানা অঞ্চলেও তৈরি হয়েছে একইরকম সবুজ প্রাচীর। কিন্তু সেখানে মরুভূমিকে বদলে ফেলার চেষ্টা না করে তার পাশের তৃণভূমি অঞ্চলকেই আরও সমৃদ্ধশালী করে তোলার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চিনের বিজ্ঞানীরা বদলে ফেলতে চেয়েছেন মরুভূমিকেই। ফলে পরিবেশের উপর যে বাড়তি চাপ পড়ছে, সে-কথা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এমন গাছ লাগানোতেও বিরক্ত পরিবেশকর্মীরা। এতে গাছের শিকড় অনেক গভীরে প্রবেশ করে এবং খুব তাড়াতাড়ি জল টেনে নেয়। ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই এলাকায় তীব্র জলসঙ্কটের আশঙ্কা করছেন তাঁরা। আর তাহলে সবুজ প্রাচীরকেও বাঁচানো সম্ভব হবে না। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, মূলত একই প্রজাতির গাছ লাগানোর ফলে একে অরণ্য না বলে বাগান বলতেই আগ্রহী অনেকে। কারণ অরণ্যের কোনো বাস্তুতন্ত্র এখানে গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। একাধিক জীবের মিলিত বাসস্থান না থাকায় কোনো একটি রোগের প্রভাবেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে সমস্ত গাছ। এমন নানা আশা ও আশঙ্কার কথা উঠে এলেও চিনের বিজ্ঞানীদের এই উদ্যোগ যে নিঃসন্দেহে অবাক করা, তাতে সন্দেহ নেই।

Powered by Froala Editor