আশি-নব্বইয়ের দশকে, তখন প্রায় সব পাঠ্য বইতে একটা কথা লেখা থাকত। ‘ভারত কৃষিপ্রধান দেশ’। বর্তমানে আশ্চর্যজনকভাবে লাইনটা গায়েব হয়ে গেছে। বিশেষ করে ২০০০ সালের পর ভারতে LPG, মানে লিবারেলাইজেশন, প্রাইভেটাইজেশন আর গ্লোবালাইজেশনের জোয়ার আসে। ফলে কৃষির গুরুত্ব (অন্তত খাতায় কলমে) পিছোতে পিছোতে একেবারে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। সার্ভিস সেক্টর আর বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি বিপুল হারে লোক নিয়োগ করতে থাকে, যার অনেকটাই ছিল মূলতঃকৃষিজীবী পরিবারগুলো থেকে। আজ থেকে বছরখানেক আগেও এই সংক্রান্ত সেমিনারগুলোতে আলোচনার একটা মূল উপজীব্য ছিল, আগামী কুড়ি বছর পরে জমিতে চাষের জন্য লোক এবং জমি কি আদৌ পাওয়া যাবে? নবীন প্রজন্ম চাষে আগ্রহী না। জমি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে প্রমোটারদের কাছে। চাষ করবে কে? সব মিলিয়ে কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়ছিল ক্রমাগত।
ঠিক এমন সময় করোনা ভাইরাসের বিশ্বজোড়া এই প্রাদুর্ভাব ঘটল। মারা যেতে লাগলেন বহু মানুষ। বন্ধ হল কলকারখানা। চাকরি হারালেন অগণিত পুরুষ ও মহিলা। এখনও সেই দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে উঠতে পারছি না কেউই। পথের শেষ আজও ঘন অন্ধকারে আবৃত। কিন্তু সবটাই তাই কি? একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। এই করোনার আবহে ভারতের (বিশ্বেরও) Purchasing Managers Index (PMI) কমছে হু হু করে। এই ব্যাপারটা কী? কিছুই না, দেশের মোট উৎপাদনের ঠিক কতটা কলকারখানায় উৎপাদিত হচ্ছে, তার পরিসংখ্যান। এই সূচক কমা মানে কারখানায় উৎপাদন কম হচ্ছে। কেন কম? সেটাও আমাদের জানা। বিক্রি এবং মাল পরিবহন এখন প্রচণ্ড অসুবিধার মধ্যে রয়েছে। ট্রেন চলছে না। সড়ক পরিবহনও স্বাভাবিক না। ফলে পি এম আই কমতে কমতে ২৫% র কাছে পৌছে গেছে, যেটা গত ১৫ বছরের সর্বনিম্ন। আরও নামছে। পাশাপাশি এই সময়টুকুতেই কৃষি উৎপাদনে বৃদ্ধি হয়েছে ৩%। মানে লক ডাউন পরিস্থিতিতে কৃষি শুধু নিজেকে রক্ষাই করেনি, নিজেকে আরও ফলবতী করেছে। আরও দু একটা শুকনো কথা বলি। Confederation of Indian Industry (CII) কিছুদিন আগেই একটা পরিসংখ্যান বার করেছিল। তাতে দুটো অদ্ভুত কথা আছে। এক - ভারতের অর্থনীতি আবার চাঙ্গা হতে খুব কম করেও এক থেকে দেড় বছর লাগবে। আর দুই- এই সময়ে ভারতের খাদ্য শস্য উৎপাদনের পরিমান ৩০০ মিলিয়ন টনের রেকর্ড ছোঁবে। শুধু তাই নয় দেশের জিডিপি-তে এই বছর কৃষির অবদান আগের সব বছরের চেয়ে ০.৫% থেকে ১.০% বাড়বে। ফলে যে ভয়ানক মন্দা দেশকে গ্রাস করতে পারত, তা থেকে মুক্তির উপায় একমাত্র কৃষিই। অবাক লাগছে? তাহলে বরং বলি চারিদিকে এই ভয়াবহ অবস্থাতেও কৃষির এই বিকাশ ঠিক কোন পথে সম্ভব হয়েছে।
স্বাস্থ্য, বিদ্যুতের মতো যে সেক্টরটি এই লকডাউনে একদিনও বন্ধ হয়নি, সেটা হল কৃষি বিভাগ। এমনকি প্রতি লকডাউনে কৃষিকে ছাড় দেওয়া হয়েছে সবার আগে। খোলা থেকেছে বীজ ও মাটি পরীক্ষাগার, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ আর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের গোটাটাই। ফলে (বিশেষত এই রাজ্যে) আমফানের ভয়াবহ ক্ষতির পরেও ফসল ধবংস যতটা হতে পারত, সে তুলনায় কম হয়েছে।
গত পাঁচমাস এক অদ্ভুত স্থানিক পরিবর্তন দেখেছে, যাকে রিভার্স মাইগ্রাশন বললে খুব ভুল বলা হবে না। করোনা পরিস্থিতিতে অনেকেই শহর থেকে ফিরে গেছেন নিজের নিজের গ্রামে। এই সংখ্যাটা নেহাত কম না। সরকারি হিসেব মত ৫ কোটি। আজ্ঞে হ্যাঁ, এতটাই। ফলে মাঠে যে শ্রমের জন্য হাত পাওয়ার কথা শুরুতেই বলা হল, তা মিটে গেছে অনেকটাই। এবারে রবি শস্য কাটার আগেই তাঁরা ফিরেছেন। যাদের জমি নেই তারাও ফসল ঝাড়াই, মান্ডিতে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি নানা রকম কাজ করে উপার্জন করেছেন আর তারপর খারিফ শস্যর জন্য জমি তৈরিতে হাত লাগিয়েছেন। ফলে উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি একক (unit) ফসলের জন্য চাষির যে খরচ, সেটা কমেছে। সেই পরিযায়ী শ্রমিকদের অনেকেই Mahatma Gandhi National Rural Employment Guarantee Act অনুযায়ী মাঠে বা মাঠের বাইরে কৃষিভিত্তিক কাজ করে (ফসল ফলানো থেকে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ) সরকার থেকে দিন-প্রতি মজুরি পাচ্ছেন। এটা অবশ্যই ভাল লক্ষণ যে সরকার এই করোনা আবহে কৃষির উপর ভরসা করে বীজ, সার, জমির নানা কাজে সাহায্যের পরিমাণ বাড়িয়েছেন। ফলে কৃষক উৎসাহিত হয়েছেন ফসল উৎপাদনে।
আরও পড়ুন
২৭ বছর পর এমন পঙ্গপালের আক্রমণ জয়পুরে, বিধ্বস্ত ২৫০০ হেক্টর কৃষিজমি
কিন্তু উৎপাদন করলেই তো চলবে না। দরকার তাঁর বিক্রিও। সে দিকে নজর রেখে কয়েকটা স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফসলের ন্যূনতম দাম বেঁধে দেওয়া, মিল মালিকদের লেভি (Levee) কমিয়ে তাঁদের আরও বেশি খাদ্যশস্য কিনে নিতে উৎসাহ দেওয়া কিংবা উদ্বৃত্ত ফসল সরকারের কিনে নেওয়া তো আছেই, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বীজ আর অন্য জায়গা থেকে না এনে নিজের স্থানীয় জায়গাতেই বীজ তৈরি। এই ব্যাপারটা একটু বলার প্রয়োজন। হাইব্রিড ফসলে এক ঋতুতে যে বীজ তৈরি হয়, তা থেকে পরের বার আর ফসল হয় না। পুরোটাই ভোজ্য হিসেবে কাজে লাগে। কিন্তু অন্য ফসলের ক্ষেত্রে এক বছরের উৎপাদন থেকে পরের বছরের বীজ তৈরি করা যায়। এই বীজ থেকেই পরের বছর বা ঋতুতে ফসল বোনা হয়। কিছুদিন আগে অবধি এই বীজ তৈরির কাজটা বিশেষ কিছু জায়গায় হত। সেখান থেকে বয়ে নিয়ে চাষিদের হাতে তুলে দেওয়া হত, বা চাষিরা কিনে নিতেন। এই লকডাউন আবহে যেহেতু পরিবহণের খরচা বেড়েছে, তাই একেবারে স্থানীয় আকারে, ছোট আকারে বীজ তৈরি করতে চাষিদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। ফলে একদিকে চাষি যেমন স্বনির্ভর হচ্ছে, অন্যদিকে বীজের জন্য খরচা কমছে।
কিন্তু এটাই যথেষ্ট না। হচ্ছে স্বনির্ভর কৃষি। এখানে ক্ষুদ্র এমনকি প্রান্তিক চাষিরাও নিজেরাই বিভিন্ন জৈব সার প্রস্তুত করেন, যা জমিতে প্রয়োগ করে উন্নত মানের ফসল উৎপাদন করছেন তাঁরা। এ ক্ষেত্রে বলাগড়ের মগরাহাটা, ইছাপুর গ্রামের কৃষকদের কর্মকাণ্ড কেস স্টাডি হিসেবে উল্লেখযোগ্য। ২০১৫-১৬ সালে এখানে স্বনির্ভর কৃষির উদ্যোগ নেওয়া হয়ছিল। এখন তাঁরা জৈব উপায়ে ফসল উৎপাদন তো করছেনই, এমনকি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট তৈরি করছেন, উপকারি জীবাণুদের ল্যাবরেটরিতে তৈরি করে রোগ-পোকা দমনে ব্যবহার করছেন— সবটাই নিজের হাতে করছেন। ফলে কৃষিতে বৈচিত্র্য আসছে, পরিবেশ সুরক্ষিত থাকছে। নতুন প্রজন্ম এই স্বনির্ভর কৃষিতে আগ্রহী হচ্ছে। সব মিলিয়ে জৈব কৃষি ও স্বনির্ভর কৃষি এক সুস্থায়ী পথের সন্ধান দেখাচ্ছে। লকডাউন আবহে দেখা যাচ্ছে, ছোটো ছোটো প্রান্তিক চাষিরাও একযোগে কমিউনিটি ফার্মিং-এর মাধ্যমে স্বনির্ভর কৃষির দিকে ঝুঁকছেন। গোটা উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে চাষির নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকছে।
আরও পড়ুন
শ্রমিক দিবসের বহু আগেই, ১ মে কৃষি উৎসব পালিত হত প্রাচীন ইউরোপে
জৈব কৃষির হাত ধরে স্বনির্ভর কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা বর্তমান পরিস্থিতিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের প্রধান ডেভিড বিসলে সাবধান করেছেন, অতিমারীর ফলে বিশ্বজুড়ে খাদ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও বণ্টন ব্যাহত। ফলে দেখা দেবে ভয়ঙ্কর খাদ্যসঙ্কট। সেই সঙ্গে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ায় হানা দেবে দুর্ভিক্ষ। এই সঙ্কট থেকে বাঁচতে শহর নয়, গ্রামের উপর ভরসা করতে হবে, এ কথা অতিমারি শুরু হওয়ার সময় থেকেই বলে চলেছেন তাবড় অর্থনীতিবিদেরা। একুশ শতকেও গ্রামীণ অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি, যা আরও মজবুত করবে জৈব কৃষি ও স্বনির্ভর কৃষি ব্যবস্থা।
ICAR (ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান সংস্থা) সম্প্রতি তাদের একটি মুখপত্রে জানিয়েছে, এই করোনা পরিস্থিতিতে একমাত্র আলোর রেখা দেখাচ্ছে কৃষি। তারা মাঠে কাজের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা কী ভাবে নিতে হবে, তার রূপরেখা তৈরি করেছে। যে সব চাষীরা নিজেরা মান্ডিতে যেতে পারছেন না, এই পরিস্থিতিতে তাঁদের জন্য করা হয়েছে National Agriculture Market (e-NAM)। এতে চাষি বাড়িতে বসেই তাঁর উৎপাদিত ফসল বেচতে পারবেন, আমাজনের সেলাররা যেমন করে। বিভিন্ন এন জি ও এই ব্যাপারে তাঁদের সাহায্য করছে। এই মুহূর্তে যখন বিভিন্ন সেক্টর ঝাঁপ ফেলছে, তখন স্বনির্ভর কৃষি, জৈব কৃষি এমনকি শহুরে মানুষদের জন্য ভার্টিক্যাল গার্ডেন তৈরি করে ফসল উৎপাদন ও উপার্জনের নতুন রাস্তা দেখাচ্ছে কৃষি। FAO বা বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বারবার বলছেন, কৃষিতে আবার মানুষকে ফিরে যেতেই হবে। নইলে বাঁচার উপায় নেই। হয় সরাসরি, নয়তো কৃষি উৎপাদন শিকলের যে কোন একটা আঁকড়ি হয়ে।
এই মুহূর্তে ভারতের GVA (Gross Value Added) এর সবচেয়ে বেশি অবদান কৃষির। একাই ১৭%-র বেশি। দেশের ৪৩% মানুষ কোনো-না-কোনোভাবে কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই পরিমাণ আগামী দিনে বাড়াতে হবে আরও। তা না হলে আগামী পাঁচ বছর পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করা যাবে না একেবারেই। করোনা আমাদের থেকে অনেক কিছু নিয়েছে, কিন্তু তার মধ্যেই মনে করিয়ে দিয়েছে সভ্যতার সেই আদিতে যা আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিল, সেই কৃষির কথা। যাকে আমরা প্রায় ভুলেই গেছিলাম গত কুড়ি বছরে। করোনা ঘাড় ধরে আমাদের আবার ফিরিয়ে দিয়েছে একেবারে স্টার্টিং পয়েন্টে।
Powered by Froala Editor