কলেজ স্ট্রিট। শুধু বাংলা বা ভারত কেন, সারা বিশ্বে এমন রাস্তা খুব কমই আছে, যার অলিগলি পাকস্থলির ভিতরে শুধু বই আর বই। যেন কোন সুদূর অতীতে এক আশ্চর্য বইয়ের বীজ কেউ পুঁতে দিয়েছিল এর মাটিতে। তা থেকেই ডালপালা বার করে তৈরি হয়েছে এই মহীরুহ। এই পাড়া স্বয়ম্ভূ। এর আদি নেই, অন্ত নেই, লয় ক্ষয় নেই… ঠিক তখনই হাতে আসে রেভারেন্ড জেমস লং-এর আক্ষেপভরা লেখা। সেই জেমস লং, যিনি মাইকেলকে দিয়ে নীলদর্পণের অনুবাদ করিয়ে হাজতবাস করেছিলেন। দেড়শো বছরের কিছু আগে, ১৮৫৭ তে জেমস লং দুঃখ করে লিখছেন “কলকাতায় কোনো বইয়ের দোকান নেই, আছে শুধু ফেরিওয়ালা। তাঁরা মাথায় ঝাঁকা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় বইফিরি করে বেড়ায়। ”এই কায়দাও অবশ্য নতুন কিছু না। ইউরোপে বই ছাপা শুরু হলে ভাল বইয়ের এত দাম ছিল, যে সাধারণ মানুষ তা কিনে পড়তে পারতেন না। তাঁদের জন্য ছিল সস্তা কাগজে বাজে ছাপা কিছু বই। এদের বলা হত চ্যাপবুক। চ্যাপবয় নামে ছেলেরা কয়েক পেনির বদলে পাড়ায় পাড়ায় এদের ফেরি করে বেড়াত।
কলকাতায় সবেধন নীলমণি হিসেবে লালদিঘির পাশে ‘সেন্ট অ্যান্ড্রুজ’ নামে একটা বিলিতি বইয়ের দোকান ছিল। লন্ডন থেকে জাহাজে করে বই এলে সাহেব মেমসাহেবরা এই দোকান থেকে বই কিনতেন। ১৭৭৮ সালে প্রথম বাংলা বই হলহেডের ব্যাকরণ ছাপা হলে তা এই দোকান থেকেই বিক্রি হত। এদিকে শ্রীরামপুর প্রেস থেকে সাহেবদের নেটিভ ভাষা শেখানোর জন্য দেদার বাংলা বই ছাপা হতে লাগল। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে রীতিমতো গ্রন্থাগার স্থাপন হল। মুশকিল হল যেহেতু খোলা বাজারে সেসব বই পাওয়া যায় না, তাইও বই চুরি হতে শুরু করল আর কালোবাজারে বিকোতে লাগল দশগুণ দামে। কলেজ কাউন্সিল ঠিক করলেন, তাঁরা নিজেরাই বই ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায্য দামে বেচবেন। কলকাতা নতুন এক ব্যাবসার নাম শুনল। বই ব্যাবসা।
কলকাতায় প্রথম বই বিক্রেতা হিসেবে যার নাম পাওয়া যায়, তিনি গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য্য। প্রথমে শুধু বই বিক্রেতা হলেও পরে একাধারে প্রেসের কর্মী, লেখক, প্রকাশক, সাংবাদিক, পুস্তকবিক্রেতা সব ভূমিকাতেই তাঁকে দেখতে পাই। কোনো এক বাবুরাম এদেশীয়দের মধ্যে প্রথম প্রেস স্থাপন করলেও ইউরোপীয় রীতিতে বই প্রকাশের ক্ষেত্রে গঙ্গাকিশোর প্রথম। শ্রীরামপুর প্রেসে কম্পোজিটর হিসেবে জীবন শুরু করে পরে কলকাতায় এসে ১৮১৬ সালে সুসম্পাদিত এবং প্রথম বাংলা সচিত্র গ্রন্থ ‘অন্নদামঙ্গল’ তিনিই প্রকাশ করেন। শুধু ছাপানোই না, বাড়ি বাড়ি ক্যানভ্যাসিং করে বইটি বিক্রির যে মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি, তাতেও গঙ্গাকিশোর অসামান্য। কাগজের বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, উৎসাহী ব্যক্তিরা তাঁর বাড়িতে এসেও বই কিনতে পারতেন।
১৮১৭ সালে স্থাপিত হয় স্কুল বুক সোসাইটি। হিন্দু কলেজের পাশেই ছাত্রদের জন্য তাঁরা একটা বইয়ের দোকান খোলেন। শুধু ছাত্ররাই না, সাধারণ মানুষও সেই দোকানে বই কিনতে আসত। প্রায় একই সঙ্গে শোভাবাজার রাজবাড়ির বিশ্বনাথ দেব একেবারে অন্য স্বাদের সস্তা বই প্রকাশ শুরু করেন। ইনিই বটতলার বইয়ের স্রষ্টা। শোভাবাজার-চিৎপুর এলাকার একটি বিশাল বটগাছকে কেন্দ্র করে এই নামের উৎপত্তি হয়। অনেকে বলেন এই বটগাছের নিচেই নাকি চার্নক সাহেব বসে হুঁকো টানতেন। সেই বটগাছ এবং তার আশেপাশের এলাকায় যে মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্প গড়ে উঠেছিল, তা প্রধানত সাধারণ ও অর্ধশিক্ষিত পাঠকের চাহিদা মেটাত। এখানে হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীরাই ছিলেন। যদিও মুসলমানেরা মূলতঃ কলিঙ্গা বাজার, মানে নিউ মার্কেটের পুবে দোকান দিয়েছিলেন। সামনে দোকান পিছনে প্রেস। এছাড়াও লল্লুলাল নামের এক প্রকাশকের নামও দেখতে পাই, যদিও তাঁর সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না।
এভাবেই চলত, যদি না ১৮৪৭ সালে স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বই ব্যবসায় নামতেন। সেই বছর ছয়শো টাকা দিয়ে আর্মহার্স্ট স্ট্রিটে সংস্কৃত যন্ত্রালয় নামে একটা কাঠের প্রেস কিনে বিদ্যাসাগর মশাই আরপুলি লেনে একটা বইয়ের দোকানও খুলে ফেললেন। নাম রাখলেন সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি। এটি এক ঐতিহাসিক ঘটনা। বর্তমান কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে সিরিয়াস বই ব্যবসার সেই শুরু। যেহেতু নাম ‘ডিপজিটরি’ তাই তাঁর নিজের লেখা বই ছাড়াও অন্যের বইও ছাপা হত এখানে। তাঁর বইয়ের দোকানে নিজের প্রেসের বই ছাড়াও অন্য অনেক লেখক তাঁদের বই বিক্রির জন্য রেখে যেতেন। বই বিক্রি হলে কমিশন কেটে টাকা দেওয়া হত। চেনা চেনা লাগছে? লাগবেই তো। আজও কলেজ স্ট্রিটে তাঁর দেখানো পথেই ব্যাবসা চলছে। যথাসময়ে প্রাপ্য অর্থ বুঝিয়ে দেওয়া আর যথাযথ হিসেবের জন্য বিখ্যাত হয়েছিল ‘বিদ্যাসাগরের বইয়ের দোকান’। সৎ পুস্তক বিক্রেতা হিসেবেও আদর্শ স্থাপন করেছিলেন তিনি।
১৮৮১ সালে কলুটোলায় স্থাপিত হল বঙ্গবাসী কার্যালয়। এরা মূলত সস্তায় ধর্মগ্রন্থ বেচলেও টডের রাজস্থান, মেডোস টেলরের ঠগীর আত্মজীবনী ইত্যাদি পুণর্মুদ্রণ করেছিলেন। এর দশ বছরের মধ্যে কলুটোলাতেই হিতবাদী কার্যালয় স্থাপিত হয়ে পরপর কতগুলো উল্লেখযোগ্য বই ছাপায়। এদের মধ্যে বত্রিশ সিংহাসন আর ত্রৈলোক্যনাথের ‘কঙ্কাবতী’-ও ছিল।
প্রথম ৫০/৬০ বছর বই বিক্রির সেরা ব্যবস্থা ছিল ফেরিওয়ালা মারফৎ বাড়ি বাড়ি বই পাঠানো। বটতলার প্রকাশকরা মূলতঃ এদের উপরেই নির্ভর করতেন। বাড়ির ভিতর মহলের মহিলাদের জন্য আসত বই- মালিনী। টাকা দিয়ে বইয়ের বিজ্ঞাপন হত না বরং বইয়ের সংখ্যা এত কম ছিল, যে নতুন বই বেরোলে সংবাদপত্রে খবর বেরোত। সমাচার দর্পণের পাতা ঘাঁটলে এমন বেশ কিছু বই প্রকাশের খবর পাওয়া যায়। লেখার রয়্যালটি বলে তখন কিছু ছিল না (এখনও আছে কী?)। অগ্রিম কিছু টাকা দিয়ে প্রকাশকরা পাণ্ডুলিপি কিনে নিতেন। যাদের সে সুযোগও ছিল না, তাঁরা নির্ভর করতেন পৃষ্ঠপোষকদের ওপরে। অনেকের মনে থাকবে, মাইকেলের ‘শর্মিষ্ঠা’ বা ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ছাপা হয়েছিল পাইকপাড়ার রাজাদের টাকায়।
খাস কলেজ স্ট্রিটে প্রথম বইয়ের দোকান খোলেন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়। প্রথম জীবনে তিনি হিন্দু হোস্টেলের সিঁড়ির তলায় ‘মেটেরিয়া মেডিকা’ বেচতেন। পরে কলেজ স্ট্রীটে নিজস্ব দোকান বানিয়ে ‘বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরী’ নামে ডাক্তারি বই বেচা শুরু করলেন। ১৮৮৩ সালে এই কলেজ স্ট্রীটেই শরৎ কুমার লাহিড়ী ‘এস কে লাহিড়ী এন্ড কোম্পানি’ নামে বইয়ের দোকান খুললেন। ১৮৮৫-তে গুরুদাসবাবু তাঁর দোকান ও প্রকাশনা নিয়ে কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটে চলে আসেন। উনিশ শতকে ওই সময় কলেজ স্ট্রিটে আর যে কটি বইয়ের দোকানের নাম পাওয়া যায়, তাঁরা হল ‘বি ব্যানার্জি এন্ড কোং’, ‘দাসগুপ্ত এন্ড কোং’ আর ‘সোমপ্রকাশ ডিপজিটরি’। আর ছিলেন আশুতোষ দেব। ইনি এ.টি.দেব. নামেই খ্যাত। ১৮৬০ সালে অভিধানের ব্যবসায় তাঁর প্রায় একচেটিয়া হাতযশ ছিল। শেষের দিকে তাঁর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সুবল চন্দ্র মিত্র সংকলিত অভিধান। এই সময় যোগেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যানিং লাইব্রেরী গল্প উপন্যাস ছাপা শুরু করল। নতুন লেখক তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রেখে ‘স্বর্ণলতা’ লিখলেও (১৮৭৩) তা ছাপার জন্য কোনো প্রকাশক এগিয়ে আসছিলেন না। যোগেশবাবু সে সাহস দেখান। বই সুপারহিট হয়। কলেজ স্ট্রিটের বই ব্যাবসা জমে উঠতে থাকে।
এর মধ্যে আলবার্ট হল ভেঙে নতুন বাড়ি তৈরি হয়। এখন সেই বাড়িতেই কফি হাউস। নতুন বাড়ির নিচের তলার সব ঘর দেখতে দেখতে ভাড়া নিয়ে নিল বইওয়ালারা। প্রথমেই ঢুকল চক্রবর্তী চ্যাটার্জী এন্ড কোম্পানি। তারপর পাশের ঘরে উঠে এল বিবেকানন্দ স্ট্রীটের কমলা বুক ডিপো। এল ‘সেন রায় এন্ড কোং’, ‘ইউ.এন.ধর’ আর সেন ব্রাদার্স (যার মালিক ভোলানাথ সেন হজরত মহম্মদকে নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেন, যাতে বিতর্কিত কিছু থাকায় তাঁকে খুন হতে হয়েছিল। কলেজ স্ট্রিটের প্রথম ও একমাত্র শহীদ প্রকাশক তিনিই)।
যাই হোক এই আলবার্ট হল ও তার আশেপাশে প্রচুর বইয়ের দোকান গড়ে উঠতে লাগল। আশেপাশের গলিরাও ভরে উঠল বইয়ের দোকানে। আর চল্লিশের দশক থেকে আচমকা গোটা কলেজ স্ট্রিট ছেয়ে গেল বইয়ের দোকানে। সে অন্য এক গল্প।
Powered by Froala Editor