‘আদিবাসী’। এই শব্দটির সঙ্গে শহুরে বাঙালি যতই নস্টালজিয়া ও আত্মীয়তাবোধে ‘জর্জরিত’ হোক না কেন, খোদ আদিবাসী অঞ্চলগুলির ছবি কিন্তু অনেকটাই আলাদা। একদিকে তথাকথিত মাতৃতান্ত্রিক সমাজ, অন্যদিকে উপার্জন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার নারীরা। এ-ঘটনা আদিবাসী সমাজের সব জায়গাতেই কমবেশি একই। কিন্তু বাংলা-লাগোয়া ঝাড়খণ্ড এলাকায় এই দৃশ্যটা ঠিক কীরকম? কতটা ‘স্বাধীন’ সেখানকার ভূমিপুত্রীরা?
পৃথক রাজ্য হয়ে ওঠার আগে ঝাড়খণ্ড একটি প্রান্তিক অঞ্চল-ই ছিল। সাধারণত ভারী শিল্প এবং খনিজ সম্পদের প্রাচুর্যের জন্য জামশেদপুর ও সংলগ্ন অঞ্চলগুলিতে উন্নয়ন হয়। নিশ্চিত ভাবেই এই উন্নয়নে লাভ হয় প্রান্তিক এবং দলিত শ্রেণির মানুষদেরও। কিন্তু তাঁরা যতটা লাভবান হতে পারতেন ততটা লাভবান হন কিনা তা তর্কসাপেক্ষ। আর এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে প্রান্তিক এবং দলিত নারীদের উন্নয়ন প্রত্যক্ষ ভাবেই সম্পর্কিত।
আরও পড়ুন
আর ঘোমটা নয়, পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে নতুন লড়াই হরিয়ানার মহিলাদের
নারীর অধিকার সাফল্য এবং সমান লড়াইয়ের বিষয় নিয়ে যতই আলোচনা হোক না কেন, তাত্ত্বিক এবং এলিট নারীদের প্রেক্ষিত থেকে এই আলোচনা কেবল মুষ্টিমেয়র আলোচনাই থেকে যাবে। দলিত ও অন্ত্যজ শ্রেণির নারীদের উপর সেই আদিকাল থেকেই অত্যাচারের শেষ নেই। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের অত্যাচার, উচ্চবর্ণের অত্যাচার, তারপর জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার এবং সম শ্রেণির পুরুষদের অত্যাচার - সব মিলিয়ে আদিবাসী সাঁওতালি ও অন্ত্যজ শ্রেণির নারীদের দুঃখ-দুর্দশার অন্ত ছিল না। কী চোখে দেখা হত, তার কিছুটা হয়তো টের পাওয়া যায় ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’তে সেই আদিবাসী রমণীর প্রতি কলকাতাবাসী যুবকের দৃষ্টিপাতেই।
সে-কারণেই সম্ভবত ঝাড়খণ্ডের লোকগীতিগুলোতেও নারীদের এই অবস্থানটির চিত্র বেশ স্পষ্ট হয়েই ধরা দিয়েছে। টুসুগান, ভাদুগান কিংবা অন্যান্য রীতি-রেওয়াজের মধ্যেও অত্যাচারিত, অপমানিত এবং কষ্টে-দারিদ্রে জর্জরিত নারীর যাপনটিকে আমরা খুঁজে পাই। আবার ঝাড়খণ্ড রাজ্যটিকে নিয়ে বিভিন্ন মানুষের ধারণাটিও সেই আদিবাসী নারীর সহজ, সরল জীবনযাত্রার চিত্র কিংবা তাঁদের কোমর দুলিয়ে নাচের ভঙ্গিটিকেই ভেবে বসেন তথাকথিত এলিট সম্প্রদায়ের মানুষজন। নারীদের রচিত লোকগানে, বিভিন্ন কুটির শিল্পে সেই অবস্থানটি আমরা পাই।
আরও পড়ুন
বিয়ের পিঁড়ি ছেড়ে ভিকট্রি স্ট্যান্ড – তিরন্দাজিতে সোনা বাংলার কিশোরীর
সত্যজিৎ রায়ের প্রায় সবকটি সিনেমাতেও, আদিবাসী রমণীদের নাচ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। তিনি আদিবাসীদের চিনতেন-ই না। সে প্রসঙ্গ অবশ্য ভিন্ন। কালে কালে গ্লোবালাইজেশনের প্রভাব পড়ল আদিবাসী ও অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষজনের মধ্যেও। ভোগবাদ বাড়ল। তার সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান ততটা বাড়ল না। কিন্তু ভুবনায়নের সংস্কৃতি তাদের সংস্কৃতিকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে থাকল। যদিও আদিবাসী এবং দলিত শ্রেণির নারীদের মধ্যে কঠোর পরিশ্রমী নারীদের সংখ্যাই বেশি কারণ জীবনধারণের জন্য অনেক সময় পুরুষদের পাশাপাশি তাঁদের ভূমিকাও সমান থাকে। মাঠে-ঘাটে কৃষিকাজ করা থেকে ইন্সট্রাকশনের কাজেও তাঁদের নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা গেছে একজন মহিলা যখন কোনো কাজ করছেন, মাঠে কিংবা বিল্ডিং-এর কাজ, তখন একজন পুরুষ কর্মীর চেয়ে তাঁদের বেতন কম। একজন মহিলা রেজার মজুরি কম যেহেতু সে নারী। এই বৈষম্য ঝাড়খণ্ডের লেবার নিযুক্তিকরণে দেখা যায়! কিন্তু কেন? যেখানে একজন পুরুষ এবং একজন মহিলার কর্মক্ষেত্র এক, কাজের চাপ এক!
কিন্তু সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা যায়, তাঁদের মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নয় বরং মাতৃতান্ত্রিক সমাজ-ই আবহমান কাল ধরে প্রচলিত থাকায় এক ঘোষণাবিহীন স্বাধীনতাও নারীদের মধ্যে রয়েছে। কোনো বিশেষ মতাদর্শ এসে কিন্তু তাদের মধ্যে এই নারীস্বাধীনতার প্রসঙ্গ নতুন করে উত্থাপন করেনি। বরং জীবনধারণের সমস্যা তাঁদের মধ্যে এত বেশি, যে এ বিষয়ে সচেতন ভাবে ভাবার কারণটাই হয়তো তাঁরা খুঁজে পাননি। কিন্তু স্বাধীকারের প্রসঙ্গে অন্তত তাঁদের সমাজের দিকে তাকালে আমরা আশাবাদী হতে পারি। তখন তাঁরা বারবার গর্জেও উঠেছেন। সম্প্রতি একটি ঘটনা, ঝাড়খণ্ড বিধানসভা নির্বাচনের আগে আমরা দেখতে পারি। 'ট্রাইবাল ল্যান্ড' বিরোধী আইনে সর্বপ্রথম গর্জে ওঠেন ঝাড়খণ্ডের নারীশক্তিই। আর এই গর্জে ওঠা নারীদের জন্যই, দেখা যায়, ঝাড়খণ্ড বিধানসভা নির্বাচনের বিপুল পরিবর্তন।
আরও পড়ুন
বৃক্ষকে ঘিরে মানবিক চেতনার এক চিরন্তন উৎসব ‘করম পরব’
যদিও নারী ও শিশুর মৃত্যুর হার এখানে অনেক বেশি, তবু কন্যাভ্রুণ হত্যা বা অনার কিলিং এই ঝাড়খণ্ডের অন্ত্যজ বা দলিত বা প্রান্তিক সমাজে খুব বেশি দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ফ্যাক্টরি মালিক হোক বা উচ্চবর্ণের মোড়ল, তাঁদের দ্বারা অত্যাচারিত এবং যৌন হেনস্থার শিকার এখানে অনেকেই হয়। এখন এই সব নারীরা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে পড়াশুনোও করছেন, বাইরেও যাচ্ছেন। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়র শিক্ষিকা- এমন সমস্ত পেশাতেই তাঁদের দেখতে পাওয়া যায়। অনেক আদিবাসী মহিলা পুলিশেও যোগদান করেছেন এবং সুষ্ঠুভাবে কাজকর্ম সম্পাদন করছেন। ঝাড়খণ্ডের মেয়েরা সাফল্য পাচ্ছেন খেলাধুলাতেও। সংরক্ষণের ফলে তাঁদের মধ্যে সামগ্রিক ভাবেই স্বচ্ছলতা আসায়, আদিবাসী সমাজেও দুটি ভাগ ও দুই শ্রেণির সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপ তৈরি হয়েছে।
কিন্তু ভারতবর্ষের বর্তমান অবস্থায় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠছে ক্রমশ। ক্ষমতার সঙ্গে পুরুষতন্ত্রের এই যোগাযোগকে কেউই অস্বীকার করতে পারবেন বলে মনে হয় না। তাই ঝাড়খণ্ডে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যসম্পন্ন সমাজব্যবস্থায় আবার যে ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী বৈষম্য নেমে আসবে এ কথা বলাই যায়। আর তখন নারী স্বাধীনতা বা নারীর অধিকার নিয়ে দিবস উদযাপন করার পরিসরটাও থাকবে কি? প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়…