করোনার বিরুদ্ধে লড়াই সত্ত্বেও মেলেনি প্রাপ্য সম্মান, কেমন আছেন অ্যানেস্থিওলজিস্টরা?

চিকিৎসা ক্ষেত্রে ‘অ্যানেস্থেসিয়া’ একটি অতিপরিচিত কথা। চিকিৎসার এই বিভাগের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকরা পরিচিত অ্যানেস্থিওলজিস্ট হিসাবে। অস্ত্রোপচারের সময় রোগীকে সম্পূর্ণরূপে অচেতন করে রাখার দিন চলে গেছে। এখন রোগীর কোনো একটি বিশেষ অঙ্গকে অসাড় করে রেখেই হয় অপারেশন। আর সেটাই প্রধান কাজ এই বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু এই দায়িত্বপূর্ণ কাজের জন্য তাঁরা কি নায্য মূল্য বা সম্মান পান? এই করোনার আবহে কেমনই বা আছেন তাঁরা? এ বিষয়ে ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ অ্যানেস্থিওলজিস্ট’-এর সমীক্ষায় উঠে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য।

অ্যানেস্থিওলজিস্ট বলতে আমরা প্রাথমিকভাবে যা বুঝি, তাঁদের কাজের পরিধি তার থেকেও অনেক দূর অবধি বিস্তৃত। শুধুমাত্র অস্ত্রোপচারের সময়ই তাঁদের দরকার লাগে, এমনটা নয়। আসলে তাঁদের কাজ শুরু হয় কোনো রোগী অপারেশনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঠিক পর থেকেই। সার্জিকাল অপারেশনের পুরো সময়টাই সার্জেনদের সঙ্গেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন তাঁরা। রক্তের চাপ, অক্সিজেনের মাত্রা, শ্বাসের হার, ইউরিন আউটপুট— এসব কিছুই ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁরা। অপারেশন না হলেও আশঙ্কাজনক যেকোনো রোগীর এই জরুরি শারীরিক সূচকগুলির পরিচর্যাও করেন তাঁরাই।

করোনার আবহে বড়ো চ্যালেঞ্জের মুখে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। আক্রান্তদের একটি বড় অংশ ভর্তি রয়েছেন আইসিইউগুলিতে। আর সেখানেই সাধারণ চিকিৎসকদের থেকে বেশি দরকার পড়ছে অ্যানেস্থিওলজিস্টদের। রাত-দিন এক করেই তাঁরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন করোনা রোগীদের। করোনা আক্রান্তদের শরীরে চ্যানেলিং এবং অক্সিজেন সরবরাহের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তাঁরা। অধিকাংশ সময়ই রোগীদের সংস্পর্শে থাকার জন্য, বাড়ছে এয়ারোসলের মাধ্যমে সংক্রমণের সম্ভাবনাও। ফলে চিকিৎসকদের মধ্যে সবথেকে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন তাঁরাই। পরিসংখ্যার ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে ২০-২৫ শতাংশ অ্যানেস্থিওলজিস্টই আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। গত একমাসে মারা গেছেন ৫ জন।

‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ অ্যানেস্থিওলজিস্ট’ বা আইএসএ-র সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে জানা যাচ্ছে ভারতে এই মুহূর্তে রয়েছে দেড় লক্ষ অ্যানেস্থিওলজিস্ট। যার মধ্যে কর্মরত মাত্র ৫৫ হাজার। সাধারণ চিকিৎসাক্ষেত্রের পাশাপাশি করোনার রোগীদের দেখাশোনার কাজও তাঁদের ওপরে এখন। ফলে তৈরি হচ্ছে প্রবল চাপ। এক পিপিই কিট পরেই কাজ করতে হচ্ছে টানা ৬-৭ ঘন্টা। কাজের চাপে অনেকে পরিবারের মুখও দেখেননি দীর্ঘদিন। ঘাটতি পূরণ করতে যোগ দিয়েছেন পড়ুয়ারাও। একদিকে যেমন পাহাড়প্রমাণ কাজ, অন্যদিকে ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি— দু’দিকই মাথায় রাখতে হচ্ছে তাঁদের। আইএসএ-র এক আধিকারিক ডঃ কামনা কাক্কর তাঁর গবেষণায় জানাচ্ছেন, এই পরিস্থিতিতে শারীরিক ধকলের পাশাপাশিই বাড়ছে অ্যানেস্থিওলজিস্টদের মানসিক অবসাদও। সেই সঙ্গেই তাঁরা হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছেন বাড়ির মালিক এবং সাধারণ মানুষের থেকেও।

আরও পড়ুন
শুধুমাত্র চিকিৎসার অভাবেই ভারতে মারা যান ১০ শতাংশ মানুষ, বলছে সমীক্ষা

কিন্তু করোনা যুদ্ধে সামনের সারির এই সৈনিকদের কতটা গুরুত্ব দেয় ভারতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা? উঠছে এই প্রশ্নই। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলিতে একজন সার্জেনের থেকেও বেতন খানিকটা বেশি এই চিকিৎসকদের। সাধারণ সার্জেনদের বার্ষিক বেতন যেখানে তিন লক্ষ মার্কিন ডলারের মত। সেখানে তাঁদের এবং কার্ডিওলজিস্টদের বেতন ৩.৪৩ লক্ষ। কিন্তু ভারতে তাঁদের বেতন একজন সার্জেনের মাত্র ৩০ শতাংশ। নেই কোনো বিশেষ সম্মান এবং মর্যাদাও। উন্নত দেশগুলিতে রোগীরা পছন্দ মত সার্জেনদের সঙ্গেই নিযুক্ত করেন অ্যানেস্থিওলজিস্টদের। কিন্তু ভারতে সেই মর্যাদা থেকেও বঞ্চিত তাঁরা। চিকিৎসকদের নাম অস্ত্রোপচারে উল্লেখ হলেও, অনুচ্চারিত থাকে তাঁদের কথা। অনেকের বক্তব্যেই ফুটে উঠছে সেই আক্ষেপের সুর। তবে এই কঠিন সময়েও পিছিয়ে আসছেন না তাঁরা। রোগীদের সুস্থ করে তোলা এবং তাঁর পরিবারের মুখে হাসিই যে তাঁদের কাছে পুরষ্কারস্বরূপ, জানাচ্ছেন এই পেশায় যুক্ত ডঃ নাথ।

আরও পড়ুন
জন স্নো-র আবিষ্কার আর 'টাইফয়েড মেরি'র নির্বাসন - করোনার সঙ্গে যুদ্ধে আমাদের পাঠ দিচ্ছে ইতিহাস

আক্রান্তদের ভেন্টিলেশনে ভর্তি থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠা। এই পুরোটা সময়ই রোগীদের সমস্ত রকম পরিচর্যা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নীরবেই পালন করছেন এই অ্যানেস্থিওলজিস্টরা। দিন দিন যত বাড়ছে সংক্রমণ ততই বোঝা যাচ্ছে তাঁদের গুরুত্ব। কিন্তু সাধারণ সময়ে তাঁদের উপেক্ষার চোখেই দেখে গোটা চিকিৎসামহল। ক্ষেত্র বিশেষে রোগীরাও।

আরও পড়ুন
পেরিয়েছে ৮৭ বছর, আজও জীবাণুনাশক হিসেবে বাঙালির ভরসা ডেটল-ই

সম্প্রতি তাঁদের সুরক্ষার কথা ভেবেই এগিয়ে এসেছেন দিল্লির শ্রী বালাজি অ্যাকশন মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা। তাঁরা এক নতুন পন্থা নিয়েছেন এই প্রথম সারির কোভিড যোদ্ধাদের সুরক্ষিত করতে। তৈরি করেছেন ইনটিউবেশন বক্স। কাঁচের এই বাক্সের মাধ্যমে ঢেকে রাখা হচ্ছে রোগীর মুখ। তাতে খানিকটা হলেও কমছে সংক্রমণের আশঙ্কা। দিল্লির অ্যানেস্থিওলজিস্টরা না হয় সুরক্ষিত হলেন। বাকিরা? কবে তাঁদের মিলবে যোগ্য সম্মান? জানা নেই কারোর...

Powered by Froala Editor