এখনও সপ্তাহ পেরোয়নি। গত ৭ তারিখেরই ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রে তখন চলছে ধুন্ধুমার একটি বৈঠক। বৈঠক বলা ভুল হবে। আগামী নির্বাচনের ওপর ভিত্তি করে সহ-রাষ্ট্রপতি মাইক পেন্স এবং তাঁর ডেমোক্র্যাট প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিসের মধ্যে বিতর্ক। এই টান টান বিতর্ক ও নিশ্ছিদ্র সুরক্ষা বলয়ের মধ্যেই ঢুকে পড়ে একটি মাছি। গিয়ে বসে ডেমোক্র্যাট ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সেরই মাথায়। আর তারপরেই কার্যত সেলিব্রিটি হয়ে গেছে সেই মাছি। বিতর্কসভার আলোচনার উলটে গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় চূড়ান্ত চর্চা চলছে এই মাছিকে নিয়েই।
তবে শুধু সোশ্যাল মিডিয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই সেই মক্ষিকার আনাগোনা। অচিরেই সৃজনীতে জায়গা করে নিয়েছে মাছিটি। তাকে কেন্দ্র করে ২-৩ দিনের মধ্যেই বিখ্যাত হয়ে গেছে বিডেন কিংবা হ্যারিস ফ্লাই সোয়েটার। অন্যদিকে হ্যালোইন কস্টিউমসেও বেশ জোরালো আধিপত্য বিস্তার করেছে মক্ষিকাটি।
কিন্তু সৃজনী ও চিত্রকলায় জায়গা করে নেওয়া একমাত্র পতঙ্গ এই মক্ষিকাটি নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় বার বার বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের হাত ধরেই ক্যানভাসে জায়গা করে নিয়েছে মাছি। হয়ে উঠেছে সেলিব্রিটি। কিন্তু সামান্য এই পতঙ্গের বিখ্যাত হয়ে ওঠার পিছনে কারণ কী? চিত্র বিশেষজ্ঞদের মতে মাছি শিল্পের ইতিহাসে দীর্ঘকাল ধরে প্রতীকী অর্থ বহন করে চলেছে। সেই রেনেসাঁসের সময় থেকেই। আর ছবিতে তার উপস্থিতি মানুষের জীবনের ক্রমিক পরিবর্তনকেই সূচিত করে।
১৪৭০ সালের আঁকা জার্মার স্কুলের এক শিল্পী আঁকা হোফার পরিবারের এক মহিলার পোর্ট্রেটে দেখা যায় মাছির উপস্থিতি। দেখা যায় সেই মহিলার মাথার প্রশস্ত আস্তরণের ওপর বসে রয়েছে একটি মাছি। সাদা সেই আস্তরণের ওপর মাছির উপস্থিতি বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতোই। মাছিটির স্থির চিত্র সেখানে মনে করিয়ে দিচ্ছে জীবন কত অস্থায়ী। লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে আজও সংরক্ষিত রয়েছে সেই ছবি।
ইতালিতে ষষ্ঠাদশ শতকেও রেনেসাঁসের যুগে চিত্রশিল্পীদের দেখা গেছে ছবিতে মাছির ব্যবহার করতে। তবে সেখানে উদ্দেশ্য একটু অন্যরকমই ছিল। ইতালিয় শিল্পী জর্জিও ভাসারির বায়োগ্রাফিতে উল্লেখিত রয়েছে একটি গল্প। সমসাময়িক চিত্রকর জিওটো তাঁর শিক্ষককে বোকা বানানোর জন্য একটি মাছির ছবি এঁকেছিলেন পোর্ট্রেটের ওপরে। যা এতটাই বাস্তবদর্শন ছিল, যে শিক্ষক সিমাবুও বুঝতে পারেননি আসল রহস্য।
আরও পরের দিকের ইতিহাস দেখলে ‘মাছি’ প্রসঙ্গে উঠে আসতে বাধ্য সালভাদোর দালির নাম। তাঁর একাধিক ছবিতেই জায়গা পেয়েছে মক্ষিকা। কখনও হাইলাইটেড হয়েছে বিশেষ ভাবে। কখনও বা লুকিয়ে রয়েছে চিত্রের মূল বিষয়বস্তুর আড়ালে। অনেকটা গুপ্তচরের মতোই। উল্লেখ্য এই ‘গুপ্তচর’ কিংবা ‘স্পাই’ কথাটিরও উৎপত্তি মক্ষিকার নাম ‘ফ্লাই’ থেকেই। ফরাসি শব্দ ‘মসি’-র (মাছি) বিবর্তনে তা ‘গুপ্তচর’ হয়ে উঠেছিল। সেই যাই হোক, দালির বিখ্যাত ছবি ‘পার্সিস্ট্যান্ট অফ মেমোরি’-তে একটি উড়ন্ত মক্ষিকা দেখা যায়। মাছি ছাড়াও পিপড়ে-বাহিনীর ব্যবহারও করেছেন দালি।
এছাড়াও বহু উদাহরণই খুঁজে পাওয়া যাবে চিত্র-ইতিহাসে। তবে চিত্রকলার দিক থেকে সরে এসে কবিতার দিকে গেলেও লক্ষ করা যায় মাছির উপস্থিতি। উইলিয়াম ব্লেকের লেখা “আই অ্যাম নট আ ফ্লাই লাইক দি” কিংবা বাইবেলের এক্সোডাসে ঈশ্বরের দেওয়া শাস্তিতে ভূমিকা পালন করেছে মাছি। ছোট্ট মাছির ঝাঁক সেখানে মৃত্যু কিংবা সাংঘাতিক ভয়াবহতারই প্রতীক। প্রতীক অপ্রাকৃতিক শক্তি, ক্ষয়। কখনো কখনো দুর্নীতিরও।
বার বার বিভিন্নক্ষেত্রেই মাছিকে এভাবেই শিল্পীরা ব্যবহার করেছেন অপ্রীতিকর জিনিসের প্রতীক হিসাবে। যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি বিখ্যাত হয়ে ওঠা সেই সেলিব্রিটি মাছির ভূমিকাও কি একই? সৃজনীতে তার আবির্ভাব কি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকেই সূচিত করছে? ইঙ্গিত দিচ্ছে আসতে থাকা পরিবর্তনের? জানা নেই। তার উত্তর হয়তো সময়ই দিতে পারে...
Powered by Froala Editor