মাছ ধরা হয় ঘোড়ায় চড়ে, আজও প্রচলিত পাঁচশো বছর পুরনো সংস্কৃতি

ইতিহাস প্রসিদ্ধ ‘ডানকার্ক’-এর নামের সঙ্গে পরিচিত অনেকেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় জড়িয়ে ডানকার্কে। তার ঠিক পূর্ব প্রান্তে ২০ কিলোমিটার গেলেই মিলবে আরেক ‘ডানকার্ক’। বেলজিয়ামের (Belgium) স্থানীয় ভাষায় যার নাম ‘উস্টডুনকের্ক’ (Oostduinkerke)। সহজ করে বললে ‘পূর্বের ডানকার্ক’। বছরের প্রায় বেশিরভাগ সময় বরফে আচ্ছাদিত সমুদ্রের তীরবর্তী এই অঞ্চলের সঙ্গে বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের কোনো প্রত্যক্ষ যোগ নেই। কিন্তু প্রায়ই এখানে নজরে আসে এক অদ্ভুত দৃশ্য। নৌকো নিয়ে সমুদ্রপথে পাড়ি দিয়ে নয়, এই অঞ্চলে মাছ ধরা হয় ঘোড়ার সাহায্যে (Horseback Fishing)।

কীরকম সেই ব্যবস্থা? সমুদ্রের পাড়ের অংশের জলরাশির মধ্যে দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন এক ব্যক্তি। পরনে বর্ষাতি জাতীয় হলুদ পোশাক, পায়ে রবারের জুতো। দু’দিকে ঝুলছে বেতের ঝুড়ি, পিছনে ছড়িয়ে জাল। খানিক পরে যখন তিনি ফিরে আসবেন, দেখা যাবে ঝুড়ি ভর্তি রয়েছে স্রিম্প বা বিশেষ ধরনের চিংড়ি মাছে। যে প্রজাতির চিংড়ির দেখা মেলে উত্তর সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলেই। শুধু বেলজিয়াম নয়, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সেও ‘ক্র্যাঙ্গন ক্র্যাঙ্গন’ নামের চিংড়ির অত্যন্ত জনপ্রিয় এক খাবার। তারই সন্ধানে সমুদ্রের পারে ঘুরে বেরোয় কয়েকজন ব্যক্তি। প্রায় পাঁচশো বছর ধরে চলে আসছে এই রেওয়াজ।

তবে শুধুমাত্র গরমের সময়েই চোখে পড়বে এই দৃশ্য। কারণ বছরের বেশিরভাগ সময়েই বরফের চাদরে ঢাকা থাকে বেলজিয়ামের এই উপকূলরেখা। গ্রীষ্মকালে বরফ গলতে শুরু করলে বালিতে এসে আশ্রয় নেয় চিংড়ি-সহ অন্যান্য জলজ প্রাণী। সেই সময়েই ‘ব্রাবান্ট’ প্রজাতির ঘোড়ায় চেপে শিকারপর্ব শুরু হয়। সমুদ্রতীরের সমান্তরাল ধরে বুকসমান জলে ছুটতে থাকে ঘোড়াগুলি। উপরে বসা সওয়ারি দু’দিকে ছড়িয়ে দেন বেতের ঝুড়ি। কখনও বা সঙ্গী হয় এক বিশেষ ধরনের জাল। জলের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে যাওয়া যথেষ্ট পরিশ্রমসাধ্য কাজ। শক্তপোক্ত ‘ব্রাবান্ট’ ঘোড়ারাও হাঁপিয়ে যায় দু-এক পাক দিয়ে। তাদের বিশ্রাম নেওয়ার ফাঁকে সওয়ারিরা ঝুড়ি বা জাল থেকে আলাদা করে নেন ধৃত চিংড়িদের। 

পাঁচশো বছর আগে এটাই ছিল তাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র পদ্ধতি। ক্রমে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন বহু মানুষ। ‘মাছ ধরা’ বিষয়টিও আধুনিক হয়ে উঠেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। পাশাপাশি দেশের সীমারেখা বিভাজিত হওয়ার সঙ্গে অনেক নিয়মনীতিও জারি হয়েছে তাদের উপরে। ফলে আপাতত মাত্র কয়েক মাইল জায়গা নির্ধারিত আছে চিংড়ি-শিকারের জন্য। তীরবর্তী বাসিন্দাদের অনেকেই এখন কাজের সূত্রে পাড়ি দিয়েছেন দেশের অন্যান্য প্রান্তে। বাকিদের মূল জীবিকা চাষবাস। শুধু হাতে গোনা কয়েকটি পরিবারই আজও বহন করে চলেছেন পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য। তবে এরাও যুক্ত বিভিন্ন পেশার সঙ্গে। ঘোড়ায় চড়ে মাছ ধরাটা বর্তমানে শখে পরিণত হয়েছে। কিংবা কোনো বিশেষ উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতিযোগিতার আয়োজন হয় পরিবারের মধ্যে। 

আরও পড়ুন
জীবনের প্রতিটি রেসে পরাজিত, তবু লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে মাঠে নামত এই ঘোড়া

ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকা এক ধারাকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন কয়েকজন মানুষ। যার সঙ্গে মিশে আছে পূর্বজদের অনেক ইতিহাস, অনেক সংগ্রাম। আর সেই কারণেই ইউনেস্কোর আশ্চর্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে বেলজিয়ামের বিখ্যাত ‘হর্সব্যাক ফিশিং’।

আরও পড়ুন
অঙ্ক করতে পারত যে ‘চতুর’ ঘোড়া!

Powered by Froala Editor