ঘোড়ার পিঠে চেপে ৬০ ফুট উঁচু মঞ্চ থেকে ঝাঁপ, যে আশ্চর্য স্টান্ট দেখতে ভিড় জমাত মানুষ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি উপকূল। সেখানেই গড়ে তোলা হয়েছে কাঠ ও ধাতু নির্মিত প্রকাণ্ড এক মঞ্চ। সমুদ্রের জলতল থেকে তার উচ্চতা কমপক্ষে ৬০ ফুট, অন্যদিকে জলের গভীরতা মাত্র ১২ ফুট। উপকূল থেকে পাটাতন বিছানো খাড়াই নততল রাস্তা পৌঁছে গেছে সেই মঞ্চের ওপর। ঘোড়ার পিঠে চেপে সেই মঞ্চের ওপর থেকেই শূন্যে ঝাঁপ দিলেন এক মহিলা। ১০ সেকেন্ড, ১৫ সেকেন্ড, ২০ সেকেন্ড… শূন্যে খানিকক্ষণ ভেসে থেকে, প্রচণ্ড আওয়াজে জলরাশির ওপর আছড়ে পড়লেন অশ্বারোহী তরুণী এবং তাঁর ঘোড়া। অন্যদিকে নিউ জার্সির উপকূল ভরে উঠল ভিড় করা হাজার হাজার মানুষের উচ্ছ্বাস, আনন্দ, চিৎকারে।

ঘটনার বর্ণনা শুনে হয়তো মনে হবে এ কোনো চলচ্চিত্র বা মনগড়া গল্প-উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। তবে একসময় আক্ষরিক অর্থেই এমন আশ্চর্য স্টান্ট দেখা যেত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। না, গ্রিক মাইথোলজির ডানাওয়ালা পক্ষীরাজ ঘোড়া নয়, বরং সাধারণ ঘোড়ায় চেপেই এই ভয়াবহ স্টান্ট দেখাতেন অশ্বারোহীরা। আর তা দেখার জন্য মোটা অঙ্কের টিকিট কেটে জড়ো হতেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। 

হর্স ডাইভিং (Horse Diving)। হ্যাঁ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (USA) আমজনতার মুখে মুখে এই নামেই পরিচিত ছিল এই বিশেষ বিনোদন। বিশেষ করে বিশ শতকের শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল হর্স ডাইভিং। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোথাও না কোথাও আয়োজিত হত এই আশ্চর্য খেলা। 

না, এই স্টান্টের সঙ্গে কোনো পৌরাণিক কাহিনি জড়িত নেই। জড়িয়ে নেই কোনো প্রাচীন সংস্কৃতিও। বরং, এই বিনোদনের মাধ্যমটি ‘আবিষ্কৃত’ হয়েছিল উনিশ শতকের আশির দশকে। নেপথ্যে ডক্টর উইলিয়াম কার্ভার। নামের আগে ডক্টর ব্যবহৃত হলেও, অক্ষরিক অর্থে তিনি আদৌ চিকিৎসক ছিলেন কিনা, বিতর্ক রয়েছে তা নিয়ে। বরং, যুক্তরাষ্ট্রে তিনি বিখ্যাত ছিলেন বাইসন হান্টার হিসাবে। জীবদ্দশায় প্রশাসনের হয়ে কয়েক হাজার বাইসন হত্যা করেছিলেন কার্ভার। এই ঘটনা থেকেই তাঁর নির্মমতার সম্পর্কে আন্দাজ পাওয়া যায়। 

১৮৮১ সাল। নাব্রাস্কার প্লাটে নদীর কাঠের ব্রিজ দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। প্রচণ্ড ঝড়-জলের বিকেল। উন্মত্ত হয়ে উঠেছে প্রকৃতি। আর প্রকৃতির এই রোষের শিকার হলেন কার্ভার। ভেঙে পড়ল কাষ্ঠনির্মিত সেতুটি। টাল সামলাতে না পেরে ঘোড়া নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেন কার্ভার। উত্তাল নদীতে সাঁতরে তাঁর ঘোড়াই তাঁকে পৌছে দেয় নদীর তটে। এভাবেই প্রাণ বেঁচেছিল কার্ভারের। 

তবে যে ঘটনাটা কার্ভারকে সবচেয়ে অবাক করেছিল তা হল, এমন আশ্চর্য দুর্ঘটনার প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ। ঘটনাস্থল প্রত্যক্ষ করতে সেই ঝড়-জলের মধ্যেই হাজির হয়েছিলেন বহু মানুষ। এমনকি পরেরদিনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্ত থেকে দুর্ঘটনাস্থল দেখাতে আসেন অনেকে। সাধারণ মানুষের এই আগ্রহ দেখেই ব্যবসার ফন্দি মাথায় আসে কার্ভারের। যদি এই ঘটনা কৃত্রিমভাবে উপস্থাপন করা যায় মানুষের সামনে? এই আশ্চর্য বিনোদনের সাক্ষী হতে কি ভিড় জমাবে না সাধারণ মানুষ? 

যেমন ভাবনা তেমন কাজ। নিউ জার্সির আটলান্টিক সিটির উপকূলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি গড়ে তোলেন ৪০ ফুট উঁচু একটি মঞ্চ। তারপর শুরু হয় হর্স ডাইভিং স্টান্ট-এর প্রদর্শন। প্রাথমিকভাবে কার্ভারই এই স্টান্ট দেখাতেন। তারপর ধীরে ধীরে এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন তাঁর সন্তান ফ্লয়েড কার্ভার এবং পুত্রবধূ লরেনা। বিশেষ করে লরেনার সূত্রেই রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই স্টান্ট। সুইমস্যুট পরিহিত লরেনা এবং ‘উড়ন্ত পক্ষীরাজ’-এর পিঠে চড়ে তাঁর ঝাঁপ দেওয়া দেখতেই ভিড় জমাতেন হাজার হাজার মানুষ। 

তবে খুব একটা সুখকর হয়নি তাঁর ভবিষ্যৎ। ১৯৩১ সাল সেটা। মঞ্চের ওপর থেকে ঝাঁপ দিতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন লরেনা এবং তাঁর ঘোড়া ‘রেড লিপস’। ঝাঁপ দেওয়ার সময় ঘোড়ার পিঠ থেকে বিছিন্ন হয়ে যান তিনি। ৪০ ফুট উপর থেকে সরাসরি জলে পড়ে নষ্ট হয়ে যায় দুই চোখের রেটিনাই। অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শুধু লরেনাই নয়, পরবর্তীতে এই স্টান্ট দেখাতে গিয়ে প্রাণও হারিয়েছেন অনেক অশ্বারোহী। আহত হয়ে প্রাণ গেছে বহু ঘোড়ারও। তাও সাধারণ মানুষের আগ্রহে খামতি পড়েনি কখনও। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কয়েক বছরের জন্য এই বিনোদন বন্ধ থাকলেও, পরবর্তীতে আবার শুরু হয় এই আশ্চর্য খেলা। চলেছিল সত্তর দশক পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত প্রাণী অধিকার কর্মীদের আন্দোলন এবং প্রতিবাদে আইন করে বন্ধ করা হয় এই আশ্চর্য স্টান্ট। ১৯৯১ সালে লরেনাকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল একটি চলচ্চিত্রও। তাছাড়াও হর্স ডাইভিং নিয়ে রয়েছে একাধিক গ্রন্থ, উপন্যাস। এই আশ্চর্য বিনোদন আজও প্রশ্ন তোলে, কেবলমাত্র ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য কীভাবে প্রাণীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছে সভ্যতা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, হর্স ডাইভিং-র আবিষ্কর্তা কার্ভারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ, দর্শকরাও এই নিষ্ঠুরতার ভাগীদার নয় কি? ইতিহাসের পাতা থেকে অবলুপ্ত, নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া এই স্টান্ট প্রশ্ন তোলে আজও…

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More