“প্রতিদিন চোখের সামনে কোভিড আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ওষুধ, অক্সিজেন ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জামের প্রয়োজন তো রয়েছেই। পাশাপাশি আইসোলেশনে থাকা বহু মানুষ দুবেলা খাবারটুকুও পাচ্ছেন না। বিশেষ করে যাঁরা কর্মসূত্রে শহরে একা থাকেন অথবা বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। এই অবস্থাতেই মনে হয়, আমরা যদি নিজেরা বাড়িতে দুবেলা খেতে পারি, তাহলে তাঁদের মুখেও খাবার তুলে দিতে পারব।” বলছিলেন বেহালা নিবাসী অনুরাগ। গত রবিবার খাবার টেবিলে বসেই এই নিয়ে আলোচনা করছিলেন অনুরাগ এবং তাঁর বোন অস্মিতা। তখনই ঠিক করে ফেললেন, তাঁদেরই কিছু করতে হবে। আর এই তাগিদ থেকেই বিনামূল্যে কোভিড আক্রান্ত মানুষদের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন তাঁরা। তবে বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দেওয়ার সামর্থ্য তো নেই। তাই এক্ষেত্রে ভরসা উবের কানেক্ট বা সুইগি জেনির মতো মাধ্যমগুলি।
করোনা অতিমারীর দ্বিতীয় তরঙ্গে শহর কলকাতার নানা জায়গায় গড়ে উঠেছে এমন অনেক উদ্যোগ। মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে বাড়ির রান্নাঘর থেকেই কাজ চালাচ্ছেন তাঁরা। মঙ্গলবার শোভাবাজার নিবাসী শ্রাবস্তী ঘোষ তেমনই মায়ের সঙ্গে মিলে শুরু করেছেন রান্নার কাজ। তিনি জানালেন, “সামাজিক মাধ্যমে এরকম বেশ কিছু উদ্যোগ চোখে পড়ে। তবে বেশিরভাগই দক্ষিণ কলকাতায়। উত্তর কলকাতায় এমন উদ্যোগ সেভাবে দেখতে পাইনি। তবে করোনা ভাইরাস তো সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে।” শ্রাবস্তীর সঙ্গে এগিয়ে এসেছেন প্রতিবেশী তিনজন যুবক। বিনা পারিশ্রমিকে তো বটেই, রীতিমতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সারাদিন উল্টোডাঙা থেকে আহিরীটোলা পর্যন্ত বিরাট এলাকার মানুষদের কাছে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন তাঁরা। প্রথমদিন ১৫ জন কোভিড আক্রান্তকে খাবার পৌঁছে দিয়েছিলেন শ্রাবস্তী। দ্বিতীয়দিনে সেই সংখ্যাটা ২৫-এ পৌঁছয়। “চাহিদা বাড়তে থাকলে কতজনকে খাবার পৌঁছে দিতে পারব, জানি না। তবে সাধ্যমতো চেষ্টা তো চালিয়ে যেতেই হবে।” বললেন শ্রাবস্তী।
আরও পড়ুন
কোভিড-মোকাবিলায় ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডার, যোগাযোগ বুনছে বাংলার তরুণ প্রজন্ম
একইভাবে দমদম, নাগেরবাজার থেকে কেষ্টপুর, নিউটাউন, সল্টলেকের মানুষদের জন্য এগিয়ে এসেছেন সায়নী সেনগুপ্ত। সায়নী তাঁর মায়ের সঙ্গে রান্না করেন, আর বাবা ও ভাই সেই খাবার পৌঁছে দেন মানুষের কাছে। “সংক্রমণের আশঙ্কা তো থাকছেই। তবু চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব কন্ট্যাক্টলেস ডেলভারি করার। আর কিছু না হোক, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠতে গেলে অন্তত পুষ্টিকর খাবার খুবই প্রয়োজন।” জানালেন সায়নী। তেমনই দক্ষিণ কলকাতার ক্লাউড কিচেন ‘আনাড়ি’ থেকেও শুরু হয়েছে কোভিড আক্রান্ত মানুষদের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা। ‘আনাড়ি’ কিচেনের উদ্যোক্তা প্রিয়াঙ্কা ভট্টাচার্য জানালেন, “লকডাউনের সময়েই আমাকে কর্মক্ষেত্র থেকে ছাঁটাই করা হয়। তখনই এই ক্লাউড কিচেন তৈরি করি। তবে এই পরিস্থিতিতে আমরা শুধুই কোভিড আক্রান্ত মানুষদের কাছে খাবার পৌঁছে দিচ্ছি। কারণ তাঁদের সেটা প্রয়োজন।” দেখতে দেখতে চাহিদাও বাড়ছে। এক এক বেলায় প্রায় ৫০ জন মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন তাঁরা। প্রিয়াঙ্কা জানালেন, “প্রথমে মা আর আমি সমস্ত রান্না করতাম। চাহিদা বাড়ায় এখন ভাই প্রত্যুষকেও এসে হাত লাগাতে হচ্ছে রান্নার কাজে।” তবে প্রিয়াঙ্কার কথায়, “আমরা তো আমাদের কাজ করছি। তবে যাঁরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন, তাঁদের স্যালুট করতেই হয়।”
আরও পড়ুন
ইজরায়েলে একদিনে করোনায় মৃতের সংখ্যা শূন্য, ১০ মাসে প্রথম
আরও পড়ুন
করোনায় প্রয়াত মানবতাবাদী নেতা মৌলানা ওয়াহিউদ্দিন খান
শুধুই শহর কলকাতা নয়। রাজ্যের অন্যত্রও শুরু হয়েছে এমনই নানা উদ্যোগ। ঝাড়গ্রামের ‘শ্রমজীবী ক্যান্টিন’ এগিয়ে এসেছে একইভাবে। উদ্যোক্তা প্রতীক মৈত্র বললেন, “আমাদের এখানকার পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা। দীর্ঘ লকডাউনে সবটাই বিপর্যস্ত। যাদবপুরের মতোই রাজ্যের নানা জায়গায় তাই শ্রমজীবী ক্যান্টিন গড়ে তুলেছি আমরা। তবে বিনামূল্যে নয়, প্রতীকি ২০ টাকা মূল্য নিয়েই খাবার দেওয়া হচ্ছে।” অক্টোবর মাস থেকে এই কাজ করে আসছেন ঝাড়গ্রামের যুবকরা। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন অনেকেই ভাইরাসের সংক্রমণে গৃহবন্দী, তখন বিনামূল্যে তাঁদের ঘরে গিয়ে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন উদ্যোক্তারাই। এমনকি প্রতীক জানালেন, “কেউ যদি প্রতীকি মূল্য দিতে না পারেন, তাহলেও তাঁদের ফিরিয়ে দিচ্ছি না আমরা। এই মূল্য তো খাবারের দাম নয়, নিছক সাম্মানিক। আমরা নিজেদের মতো করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অনেকে অর্থসাহায্যও করছেন। আমাদের বিশ্বাস, মানুষকে খালি পেটে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে দিতে দেব না আমরা।”
দেশের জরুরি পরিস্থিতিতে এভাবেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের মতো তাঁরাও তো এক একজন যোদ্ধা। মানুষের এই মিলিত প্রতিরোধের কাছে ভাইরাসকে হার মানতেই হবে।
Powered by Froala Editor