‘ভিলেন’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিরুদ্ধে গণধর্মঘট হলিউডে, ভারত সচেতন হবে কি?

১৯৬০ সাল। ১৬ জানুয়ারি থেকে ১২ জুন— দীর্ঘ ১৪৮ দিনের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল হলিউডের দরজা। অধিকার এবং পেনশনের দাবিতে সেবার পথে নেমেছিলেন হাজার হাজার চিত্রনাট্যকার এবং চলচ্চিত্র-শিল্পী। শেষ অবধি প্রযোজক গোষ্ঠীকে হারিয়ে সাফল্যও পেয়েছিলেন তাঁরা। তারপর কেটে গেছে প্রায় ছ’দশক। এবার ফের বড়োসড়ো ধর্মঘটের (Strike) সম্মুখীন হল মার্কিন চলচ্চিত্রের আঁতুড়ঘর হলিউড (Hollywood)। অবশ্য এবারের এই ‘গণ আন্দোলন’-এ সুপারভিলেন ‘যান্ত্রিক মগজ’। চলতি কথায় বলতে গেলে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ (Artificial Intelligence)।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই শব্দটার সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। গত বছরই মুক্তি পেয়েছিল ইলন মাস্কের সংস্থা ‘ওপেন এআই’-এর চ্যাটবট ‘চ্যাট জিপিটি’। গাণিতিক সমস্যার সমাধান থেকে ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ, জটিল কম্পিউটার প্রোগ্রামিং থেকে শুরু করে গল্প, কবিতা, নাটক— হুকুম পেলেই মুহূর্তের মধ্যে লিখে দিতে সক্ষম এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এমনকি গবেষকদের থেকে গবেষণার সারমর্মটুকু ‘শুনে’ আস্ত থিসিস পেপার লিখে ফেলতেও সিদ্ধহস্ত সে। এ তো গেল শুধু ‘চ্যাটজিপিটি’-র কথা। তাছাড়াও ইতিমধ্যেই বৈশ্বিক বাজারে প্রভাব বিস্তার করেছে আরও বহুধরনের ‘যান্ত্রিক মগজ’। কেউ বিবরণ শুনেই এঁকে দিতে পারে ছবি, কেউ আবার তৈরি করে দিতে পারে পছন্দসই গ্রাফিক্স, অ্যানিমেশন, ভয়েস ওভার বা ডাবিং-এর ট্র্যাক তৈরি করে দেওয়াও তার কাছে জল-ভাত। ফলে, চিত্রনাট্য লিখন থেকে অ্যানিমেশন, সিজিআই, ভার্চুয়াল ও অগমেন্টেড রিয়্যালিটির দৃশ্যায়ন— হলিউড-জুড়ে প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই ইতিমধ্যে ব্যক্তিমেধার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। মানুষকে সরিয়ে তারাই হয়ে উঠছে চলচ্চিত্র জগতের চালিকআশক্তি। একদিকে যেমন কাজ হারাচ্ছেন অগণিত শিল্পী। তেমনই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌরাত্ম্যে কমেছে হলিউডি লেখক ও স্ক্রিপ্টরাইটারদের পারিশ্রমিকও।

গত ২ মে এই ঘটনার প্রতিবাদে ঘর্মঘটের ডাক দেয় হলিউডের চিত্রনাট্যকার, লেখকদের সংগঠন ‘রাইটার্স গিল্ড অফ আমেরিকা’। অবশ্য তারও বেশি কিছু মাস আগে থেকেই হলিউডের মধ্যে ক্রমশ ক্ষোভ বাড়ছিল ন্যায্য বেতন এবং উপযুক্ত কর্ম-পরিবেশের অভাব নিয়ে। সেই আগুনেই ঘৃতাহুতি করে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য। ‘রাইটার্স গিল্ড অফ আমেরিকা’-র পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ব্যক্তিশিল্পীর বিকল্প হিসাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বন্ধ হোক চলচ্চিত্রজগতে। এই দাবিকে কেন্দ্র করেই গত ১১ দিন ধরেই তাঁরা প্রতিবাদ-ধর্নায় সামিল হয়েছেন নেটফ্লিক্স এবং ডিজনি স্টুডিও-র সামনে।

হ্যাঁ, সাম্প্রতিক সময়ে এই দুই স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ও স্টুডিও-তেই ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। উদাহরণ হিসাবে ধরে নেওয়া যায়, বর্তমানে ‘ডিজনি+’-এ চলা ওয়েব সিরিজ ‘সিক্রেট ইনভেশন’-এর কথাই। ওয়েব সিরিজের শুরুতে দেখানো মিনিট দেড়েকের অ্যানিমেশনটিতে হাত নেই কোনো মানুষের। সম্পূর্ণভাবেই সেটি তৈরি হয়েছে এআই-এর মাধ্যমে। তাছাড়াও বর্তমানে  প্রি ও পোস্ট প্রোডাকশনের বহু কাজেরই দায়িত্ব সামলাচ্ছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স। সেই কারণেই মূলত এই দুই প্রোডাকশন হাউসকে প্রতিবাদের কেন্দ্র হিসাবে বেছে নেন শিল্পীরা।

অবশ্য প্রাথমিকভাবে এই আন্দোলনে সেভাবে সাড়া পড়েনি বিশ্বজুড়ে। সম্প্রতি এই একই দাবিতে হলিউডি শীর্ষকর্তা এবং প্রযোজক গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনায় বসেছিল দেড় লক্ষাধিক অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংগঠন ‘স্ক্রিন অ্যাক্টর্স গিল্ড’। বলার অপেক্ষা থাকে না, ফলপ্রসূ হয়নি সে-আলোচনা। ফলে অভিনেতা এবং অন্যান্য কলা-কুশীলবরাও হাত মেলান চিত্রনাট্যকারদের সঙ্গে। বেছে নেন আন্দোলন, ধর্মঘটের পথ। ইতিমধ্যেই যা সাড়া ফেলে দিয়েছে বিশ্বজুড়ে। থমকে গেছে ‘ডেডপুল ৩, ‘মিশন ইম্পসিবল’-এর মতো জনপ্রিয় হলিউড ফ্র্যাঞ্চাইসির কাজ।

অবশ্য এআই-এর ব্যবহার নিয়ে মার্কিন চলচ্চিত্রজগৎ আন্দোলিত হলেও, এখনও অসন্তোষ দানা বাঁধেনি ভারতের চলচ্চিত্রমহলে। কিন্তু এই একই পথে কি ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে না এ-দেশের বিনোদন ব্যবস্থা? মাত্র কয়েকদিন আগের কথা। সংবাদমাধ্যম-জুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিল ওড়িয়া সংবাদ সংস্থা ‘ওটিভি নেটওয়ার্ক’-এর সঞ্চালিকা লিসাকে নিয়ে। লিসা কোনো রক্ত মাংসের মানুষ নয়। এআই-এর ওপর নির্ভর করেই জন্ম তার। তবে তার চেহারা দেখে কে বলবে সে যন্ত্রের উপস্থাপক মাত্র! তার উচ্চারণ, মুখভঙ্গি হুবহু মানুষের মতোই। তাকে বেতন দেওয়ার ঝঞ্ঝা নেই কোনো। নেই বিরতি, ছুটি দেওয়ার অবসরও।

বলার অপেক্ষা থাকে না, ‘লিসা’-র মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এ-দেশে ক্রমশ কাজ কেড়ে নেবে অজস্র মানুষের। সংবাদমাধ্যমের বাইরে চলচ্চিত্র বা অন্যান্য ক্ষেত্রেও তার প্রকোপ পড়বে না— সে-কথা কে বলতে পারে হলফ করে? সে-নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নয় এদেশের মানুষ। বরং, চিন্তা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে পরিবেশিত হতে পারে ভুল তথ্য। ‘ইয়েলো জার্নালিজম’-এর আশঙ্কা নিয়েও চলছে চর্চা। তবে এসবের তলায় তলায় ১৪০ কোটির দেশে ক্রমশ বেড়ে চলেছে বৃহত্তর এক সংকট, হুঁশ নেই আমাদের। অস্বীকার করার জায়গা নেই, এআই বা প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু ব্যক্তিমেধা, রক্ত-মাংসের শিল্পীদের দাঁড়াবার প্ল্যাটফর্ম প্রদান করার জন্য, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ ব্যবহারের পরিসর নির্ধারণ করারও প্রয়োজন থেকে যায় বইকি। কিন্তু কবে সে-ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে এ-দেশে? কবে ঘুম ভাঙবে ভারতীয়দের? জানা নেই উত্তর…

Powered by Froala Editor

More From Author See More