“একটা সময় দরজা বন্ধ করে লেপ, কাঁথা মাথায় জড়িয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতাম। যেন বাইরের কারো কানে আমার কান্নার শব্দ না পৌঁছায়, পৌঁছালে সেটাকে কেন্দ্র করেই তো আবার বুলি করা হবে! এখন প্রটেস্ট করি, প্রতিবাদ করি; আর চুপ থাকি না। সেই ছোটবেলার যতটুকু গভীরে ঢুকতে পারি আমি ততটুকুতেই মনে পড়ে, শরীরে আমি এক ছিলাম আর মননে আরেক! এই শরীর এবং মনের দ্বন্দ্ব চলত সারাক্ষণ! একটি জীবন বিভীষিকায় পরিণত হতে এর চেয়ে বেশি আর কি প্রয়োজন? ভেতরে একটা নারীসত্তা লালন করছি আমি নীরবে।”
বলছিলেন হোচিমিন ইসলাম। বাংলাদেশ তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ায় ট্রান্সজেন্ডার আন্দোলনের অন্যতম মুখ। ছোটো থেকে আজ অবধি দীর্ঘ লড়াইয়ের সাক্ষী থেকেছেন তিনি। যন্ত্রণা, অপবাদ পেয়েছেন সমাজের কাছ থেকে; এখনও পাচ্ছেন। তবুও লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এই লড়াই যে তাঁর একার নয়; তাঁর সঙ্গে রয়েছে আরও বহু মানুষ। সবার কথা তুলে ধরতে হবে, সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে আরও অনেকটা পথ…
বাবা ছিলেন কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন। তাই ঘরে যখন সন্তান জন্মাল, তখন বিপ্লবকে স্মরণ করেই নাম রাখলেন ‘হোচিমিন’। স্বপ্ন কেটে গিয়ে বাস্তবের রুক্ষ জমি নেমে আসতে বিশেষ সময় লাগল না। নিজের ভেতরের নারীসত্তাকে ছোটো থেকেই চেনার চেষ্টা করেছিলেন হোচিমিন। পেরেওছিলেন চিনতে; কিন্তু ভয়! পড়াশোনা করে বড়ো জায়গায় যাওয়ার পরিকল্পনা, আর ভেতরে চেপে রাখা নিজের স্বাধীন সত্তাকে। যেন ঘর বন্ধ করে বসে আছে একটা পাখি। কারণ তিনি জানেন নিজের দেশের পরিস্থিতি। সেখানে ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের কী চোখে দেখা হয়, কী পরিণতি হয়, জানেন সেটাও। কিন্তু এরকমভাবে দমবন্ধ করে আর কতদিন?
আরও পড়ুন
‘ছেলে থাকলে উপার্জন আসত সংসারে’, অভাবী মায়ের ভুল ভাঙছেন ২১ বছরের বাঙালিনী
আরও পড়ুন
বিবাহ থেকে পারলৌকিক ক্রিয়া - ছক ভাঙছেন কলকাতার 'মহিলা পুরোহিত' নন্দিনী
“ইন্টারমিডিয়েটে শহরের বেসরকারি ব্যায়বহুল একটি কলেজে ভর্তি হলাম। সবার বাবারা মায়েরা গাড়ি করে কলেজের দরজায় নামায় দিয়ে যায়; আমার বাবা কলেজের পেছন রাস্তা দিয়ে ভাঙা সাইকেলে করে এক কোণে নামিয়ে দিয়ে যায় আর এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখে কেউ আবার দেখে ফেলল না তো! সেটা নিয়েও তো আবার বুলি হবে আমার উপরে, মজা নেবে অনেকে!”— এমনই বহু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন হোচিমিন। এখনও হয়ে চলেছেন। বর্তমানে পেশাসূত্রে বাংলাদেশের অন্যতম নামী এবং সবথেকে বড়ো বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত। সেখানে তিনি কার্ডিয়াক আইসিইউ বিভাগের নার্স। কাজের জায়গায় যেদিন প্রথম যান, সেদিন থেকেই নির্যাতনের শুরু। সহকর্মীদের কাছ থেকে জুটত অবহেলা। মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন তো রোজকার ব্যাপার হয়ে গেল। ততদিনে নিজের ট্রান্সজেন্ডার নারীর পরিচয়কে প্রকাশ্যে এনেছেন তিনি; আর লুকিয়ে রাখেননি। হাজার ঝড় ঝাপটা সহ্য করেও ডানা মেলেছেন তিনি। তবে এখন হোচিমিন যে ডিপার্টমেন্টে আছেন, সেখানে কোনো সমস্যা নেই। সবাই সেখানে আপন করেই নিয়েছেন তাঁকে।
আরও পড়ুন
কবিতাই অস্ত্র তাঁর, বিশ্বের দরবারে আদিবাসী স্বর পৌঁছে দিচ্ছেন ঝাড়খণ্ডের তরুণ কবি
আরও পড়ুন
ধর্মের ভিতর থেকে গোঁড়ামির বিরোধিতা, শাহিনা জাভেদ এক অন্যস্বরের নাম
কিন্তু সমস্যা নেই বললেই কি সব থেমে যায়? যে পরিবারে বড়ো হয়েছেন তিনি, মেলে ধরেছেন নিজেকে; সেই পরিবারই তাঁকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। যতদিন তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ প্রকাশ করেননি, ততদিন সবাই কাছে টেনেছিল। পরবর্তীতে সেই ছবিটাই উল্টে গেল। কেন গোপন করেছিলেন নিজেকে? উত্তরে উঠে আসে একরাশ দীর্ঘশ্বাস। নয়তো বাংলাদেশে তিনি চাকরি পেতেন না, পড়াশোনাও করতে পারতেন না! “একটি ইয়ুথ অর্গানাইজেশনের সঙ্গে কাজ করতে গেলাম আমি। সেটি ছিল জেন্ডার এবং সেক্সুয়ালিটির উপরেই। সেখানে গিয়েও দেখলাম তাঁরা ট্রান্সজেন্ডার বাদ রেখে কাজ করবেন! বাদ পড়ার ভয়ে চেপে গেলাম আবারও নিজের আইডেন্টিটি! চালিয়ে দিলাম নিজেকে অন্য এক নামে আমি এটি, ওটি নই বলে!”
আরও পড়ুন
গোটা দেশে, এমনকি কলকাতায় আজো প্রকাশ্যে বিকোচ্ছে অ্যাসিড, লড়াই থামেনি, বলছেন লক্ষ্মী আগরওয়াল
একা হোচিমিন ইসলাম নন, প্রায় সমস্ত ট্রান্সজেন্ডার নারীর ক্ষেত্রেই এটি কঠিন বাস্তব। আজ সেই মানুষদের জন্যই লড়ছেন হোচিমিন। বাংলাদেশের এলজিবিটি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে উঠেছেন তিনি। নিজের কাজ সামলে এই মানুষগুলোর পাশে এসে দাঁড়ান মানুষ হিসেবে। তাঁদের কথা পৌঁছে দেন বিশ্বের অন্যান্য জায়গায়। বগুড়ায় তৈরি করেছেন নিজের একটি সংগঠন, নাম "কৃষ্ণচূড়া"। এছাড়াও ‘সায়ান’ অর্থাৎ সাউথ এশিয়ান ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশন নেটওয়ার্কের সাম্মানিক সদস্য তিনি, বাংলাদেশের প্রতিনিধি। আজ কেবলমাত্র একটি দেশের মধ্যেই আবদ্ধ নেই তিনি। কিন্তু তাও অত্যাচার কি কমেছে? নানা সময় তাঁর ওপর আক্রমণও করা হয়েছে। ধর্মীয় বেড়াজালে আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু যার নাম হোচিমিন, তিনি কি আর কোনো গণ্ডিতে আটকে থাকেন? আঘাত সহ্য করেও প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন তিনি। পাশে পেয়েছেন আরও হাজার হাজার মানুষকে…
নারীসত্তা যে শুধু শরীরেই হয় না, এই কথাটাই বারবার বলে এসেছেন হোচিমিন ইসলাম। কেন একজন নারীকে কেবল শরীর দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা হবে? মনের দিকটা কি কেউ বিবেচনা করবে না? কেন আজও শরীর থেকে বেরোতে পারছি না আমরা? বারবার এই প্রশ্নগুলো তুলেছেন তিনি। নিজের সঙ্গেও প্রতিনিয়ত চলে লড়াই। দিনের শেষে জিতে যায় মনই। ওরই তো কেবল ডানা আছে; যার ওপর ভর করে নানা জায়গা উড়ে বেড়ানো যায়! তাই তো করোনা ও লকডাউনের ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও ছুটে গেছেন প্রান্তিক মানুষদের কাছে। ট্রান্সজেন্ডার, হিজড়া ও যৌনকর্মীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন রসদ। দেখেছেন তাঁদের স্বাস্থ্য ঠিক আছে কিনা। কারণ তাঁরা পাশে না এলে তো আর কেউ আসবে না! দূরে ঠেলে রাখবে। এদেরও তো বাঁচার অধিকার আছে! হোচিমিন সেই মানুষগুলোর কাছেও পৌঁছে যান বারবার। যাবতীয় সামাজিক ট্যাবু দূরে সরিয়ে একদিন যেন রামধনু ওড়ে আকাশে; যেখানে সবাই নিজের নিজের জায়গা খুঁজে পাবে। হোচিমিন ইসলামের স্বপ্ন এটাই; আরও হাজার হাজার হোচিমিনের পাশে দাঁড়াতে হবে। সবাই মিলে তৈরি হবে একটা সুখী পৃথিবী…
Powered by Froala Editor