“প্রথম গিটার বাজানোর অভিজ্ঞতা তো সেই হবনার। যদিও সেটা আমার নিজের কেনা ছিল না। উপলের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলাম। তারপর নিজেও গিয়েছি সেই বাগবাজারের দোকানে। গিটার কিনতে, তার স্ট্রিং কিনতে। অনেক গল্প হত। তখন তো আমাদের গান সেভাবে কেউ শুনত না।” হবনারের কথা উঠতেই, প্রথম জীবনের স্মৃতিতে বুঁদ চন্দ্রবিন্দু-র অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়।
জগত মুখার্জি পার্ককে বাঁ-হাতে রেখে গিরীশ অ্যাভেনিউ ধরে খানিকটা উত্তরে হাঁটলেই বাঁ-দিকে দেখা যাবে মলিন সাইনবোর্ড। তার উপড়ে জ্বলজ্বল করছে লেখা, ‘হবনার মিউজিক, আমাদের কোনো শাখা নেই’। হঠাৎ দেখেই থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। নামটা যে বিশেষ চেনা। “কিন্তু এখনও টিকে আছে হবনার?” নিজের মনের মধ্যে উঁকি দেওয়া প্রশ্নটাই আবার শুনতে পাই সঙ্গীতশিল্পী সিধুর মুখেও। হ্যাঁ, ৫ দশকের ইতিহাস বুকে নিয়ে আজও টিকে আছে হবনারের গিটার। বয়স থাবা বসিয়েছে। কিন্তু একেবারে ভেঙে ফেলতে পারেনি।
দোকানের ভিতরে তখন একমনে কাজ করে চলেছেন দিলীপ খাঁড়া। না, নতুন গিটার তৈরির নয়। একটি পুরনো ইলেকট্রিক গিটারের যন্ত্রাংশ ঠিক করছেন তিনি। কথায় কথায় জানা গেল, সেই ৮০-র দশক থেকে হবনারের সঙ্গে জড়িয়ে তিনি। তখন অবশ্য নিতান্তই ছোটো ছিলেন। তবু হাতের কাজ পাকিয়ে নিয়েছিলেন তখনই। আর কলকাতার তরুণ প্রজন্ম তখন রক মিউজিকের সঙ্গে আপন করে নিচ্ছে স্প্যানিশ বাদ্যযন্ত্রটি। মন দিয়ে ফর্মা মেপে গিটার তৈরি করতেন দিলীপ খাঁড়া। তবে, “এখন আর সেই চাহিদাও নেই। সেই ব্যস্ততাও নেই।” বলছিলেন তিনি।
আজও বাঙালির ঘরে ঘরে গিটারের চাহিদা কমেনি। শুধু পাশ্চাত্য সঙ্গীত নয়, খাঁটি ভারতীয় গানেও অনায়াসে ঢুকে পড়ে এই যন্ত্র। কিন্তু হবনারের চাহিদা আর নেই। কেন? প্রশ্ন করায় রীতিমতো অভিমানী হয়ে ওঠেন দিলীপবাবু। “মানুষ কি ভালো জিনিসের মূল্য বোঝে? আমাদের গিটারের দাম বেশি। তার থেকে সস্তায় অনেক বিদেশি গিটার পাওয়া যায়।” তবে গিটারের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে প্রকৃতি-পরিবেশ। বিদেশি গিটারগুলো সেদেশের জলবায়ুর মতো করে তৈরি। আমাদের মতো আর্দ্র দেশে খুব তাড়াতাড়ি সেসব খারাপ হয়ে যায়। হবনারের একটি গিটার কিন্তু এখনও অনায়াসে পাঁচ বছর চলে যায় বলে মনে করেন দিলীপবাবু।
আরও পড়ুন
মৃতদেহ ঠুকরে খেত চিল-শকুনে, শেষকৃত্যের সেই ঠিকানা কলকাতায় রয়েছে আজও
যাত্রাটা শুরু হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। কলকাতা তখন হিপিদের আখড়া। তাদের হাত ধরেই গিটারের সঙ্গে আত্মীয়তা বাঙালির। কিন্তু তাই বলে খাঁটি বাঙালি উদ্যোগে গড়ে উঠবে একটি গিটারের কারখানা? ভাবতে অবাক লাগে বৈকি। কিন্তু এমনটাই সত্যি করেছিলেন মুকুন্দ বিশ্বাস এবং তাঁর বন্ধুরা। প্রথমদিকে পার্ক স্ট্রিটের বারগুলির মিউজিশিয়ানরা আসতেন। তারপর ধীরে ধীরে পাশ্চাত্য সঙ্গীত একটু একটু করে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করল। আর তার সঙ্গে জনপ্রিয় হল গিটার।
‘জীবনমুখী গানের সময়টাই ছিল হবনারের সোনার সময়”, বলছেন দিলীপ খাঁড়া। তখন এমন কোনো শিল্পী ছিলেন না, যিনি হবনারে আসেননি। হবে নাই বা কেন? তখন তো বিশ্বায়নের ঝড় ওঠেনি। অসংখ্য বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পড়তে হয়নি। কিন্তু বিগত এক দশকে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যেতে চলেছে হবনার। মুকুন্দ বিশ্বাস এখন সিগনেচার কোম্পানি নিয়েই বেশি চিন্তিত। হবনার নিয়ে হয়তো আশাই ছেড়ে দিয়েছেন। “তবুও কলকাতার একটা ঐতিহ্যকে এভাবে হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না।” বলছেন সিধু। হ্যাঁ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার কিছু উন্নতি প্রয়োজন। তবে সেই কাজটা খুব কঠিন নয়। প্রয়োজনে পাশে থাকার আশ্বাস দিলেন সিধু এবং অনিন্দ্য দুজনেই।
আরও পড়ুন
কলকাতার ‘মহেন্দ্র’কে নাটোরের রাজকন্যার প্রেমপত্র; ১৫০ বছর আগেকার না-জানা গল্প
তবে এরপরেও ছবিটা বদলাবে কি? একসময় হবনারের জন্য কাঠ আসত ওড়িশা থেকে। এখন আর ওড়িশার জঙ্গল থেকে কাঠ পাওয়া যায় না। সুদূর কেরালা থেকে কাঠ আনতে সময় এবং খরচ দুইই বাড়ে। গাছ বাঁচাতে না পারলে শিল্প বাঁচবে না, স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন দিলীপ খাঁড়া। এরপরের ভবিষ্যতটা ভবিষ্যতই বলতে পারবে। তবে একসময় ইউরোপেও চাহিদা ছিল কলকাতার যে কোম্পানির, তাকে এভাবে হারিয়ে যেতে দেবে না বাঙালি। এই বিশ্বাসটুকু এখনও মনের মধ্যে রেখে দিয়েছেন দিলীপ খাঁড়া। সেই ছোট্ট কারখানাটাই একদিন কাজের ব্যস্ততায় ভরে উঠবে, স্বপ্ন দেখেন তিনি।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
বৌদ্ধ ভিক্ষু, বিকেলের আলো-আঁধারি ও কলকাতার হিউএন সাং-এর মন্দির