তিন বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে বিশ্বযুদ্ধের। আমেরিকা লড়াই করছে তিন বছর ধরে। ক্রমশ জার্মানরা যে কোণঠাসা হয়ে আসছে— তেমনটাই ফলাও করে ছাপা হচ্ছে তাবড় মার্কিন সংবাদপত্রগুলিতে। বেতারেও প্রকাশিত হচ্ছে তেমনই জয়-জয়-রব। ঠিক এমন সময়ই চমকে উঠল গোটা নিউইয়র্ক। এই যুদ্ধ পরিস্থিতি সোজা আমেরিকায় এসে হাজির হয়েছেন স্বয়ং হিটলার! সাধারণ মানুষের মনে একধাক্কায় সন্দেহ জাগল, তবে কি এতদিন মিথ্যে সম্প্রচার করে এসেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম?
হ্যাঁ, এমনটাই ঘটেছিল ১৯৪৪ সালে। নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারে সেদিন সকাল সকাল স্যুটকেস নিয়ে মার্চ করতে দেখা গিয়েছিল অ্যাডলফ হিটলারকে। সঙ্গে ছিলেন গোয়েবেল, হেস, গোয়ারিং-এর মতো উচ্চপদস্থ জার্মান সেনাধ্যক্ষ। নাৎসি সেনার পোশাকেই তাঁরা গটমট করে এগিয়ে চলেছেন আমেরিকার রাজপথ ধরে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত প্রান্তেই তখন সুরক্ষার জন্য বন্দোবস্ত করা হয়েছে প্রতিরক্ষা বাহিনীর। তাঁরাও সামরিক পোশাকে ছড়িয়ে ছিলেন সেদিন নিউ ইয়র্কে। কাজেই প্রাথমিকভাবে সাধারণ শহরবাসীর চোখ এড়িয়ে যায় বিষয়টা। তবে কাছ থেকে দেখতে পেয়ে ভুল ভাঙে অনেকের। ছড়িয়ে পড়ে ত্রাহি রব। ছুটে আসে মার্কিন বাহিনীও। চার জার্মান বনাম গোটা মার্কিন বাহিনী। এবার তবে দাঁড়ি পড়তে চলেছে বিশ্বযুদ্ধে? নাকি ছদ্মবেশে শহরজুড়েই লুকিয়ে রয়েছে জার্মান সেনারা? গোটা আমেরিকার দখল নিতে তারা এসে হাজির হয়েছে এখানে? নাকি আত্মসমর্পণ করতে চান হিটলার?
এসবের মধ্যেই ভুল ভাঙল কিছুক্ষণ বাদে। টুপি নামিয়ে প্রজাপতি গোঁফ খুলে ফেললেন হিটলার। হ্যাঁ, দিনটা ছিল পয়লা এপ্রিল। এমন অদ্ভুতভাবেই সকলকে এপ্রিল ফুল করেছিলেন মার্কিন চলচ্চিত্রকার জন ফ্যারো। রসিকতা করে তিনিই সেদিন টাইম স্কোয়ারে এনে হাজির করেছিলেন তাঁর প্রকাশিতব্য সিনেমা ‘দ্য হিটলার গ্যাং’-এর অভিনেতাদের। ১৯৪৪ সালেই প্রকাশিত হয়েছিল সেই সিনেমা।
আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মেডেলজয়ী বাবা, জানতেন না সন্তানরাও!
মূলত সেই ছবি ছিল সিউডো-ডকুমেন্টারি বা আধা-তথ্যচিত্র। অর্থাৎ? তা খানিকটা মনগড়া আর খানিকটা সংবাদমাধ্যম এবং সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে। তবে ‘প্যারামাউন্ট পিকচারস’ প্রযোজিত এই সিনেমার মূল আকর্ষণ ছিল অন্য জায়াগায়। সিনেমার জন্য কোনো রকম কাস্টিং করেননি ফ্যারো। বরং সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত নাৎসি নেতৃত্বদের লুক-অ্যালাইক খুঁজে বার করেছিলেন তিনি। তারপর তাঁদেরকে অভিনয়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে অভিনয় করিয়েছিলেন সিনেমায়।
হিটলারের চরিত্রে দেখা গিয়েছিল রবার্ট ওয়াটসনকে। হারমান গোয়ারিং হয়েছিলেন আলেকজান্ডার পোপ। অভিনেতারা এতটাই সমদর্শনীয় ছিলেন সত্যিকারের জার্মান নাৎসি নেতাদের সঙ্গে যে ভিমরি খেয়েছিল খোদ মার্কিন বাহিনীই।
আরও পড়ুন
সুড়ঙ্গের ভিতরে ২৭০টি মৃতদেহ! প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চিহ্ন ফ্রান্সে
যদিও চলচ্চিত্রটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে বহু। একদিকে যেমন বাস্তবের সঙ্গে তার অমিলগুলোকে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়, তেমনই অনেকে স্রেফ ‘প্রোপাগান্ডা’ বলেই দেগে দেন এই সিনেমাকে। তবে সিনেমা-সেন্সে ক্লিনচিট পেয়েছিলেন পরিচালক। তৎকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে রুপোলী পর্দায় এহেন চমক দেওয়ার কথা সত্যিই ভাবতে পারেননি দ্বিতীয় কেউ। তবে তার থেকেও বড়ো সাফল্য ছিল বোধ হয় সিনেমার কাস্টিং। যে কাস্টিং গোটা শহরকে চমকে দিয়েছিল মুহূর্তে। ‘দ্য হিটলার গ্যাং’ নিয়ে বহু চর্চা আজও হয়ে চলেছে। কিন্তু সেই ঘটনা যেন পুরোটাই বিস্মৃতির আড়ালে। শুধু কিছু পেপার কাটিংয়ের মধ্যেই জীবিত রয়েছে সেই ঐতিহাসিক পয়লা এপ্রিল…
Powered by Froala Editor