ভেসে এল কান্নার শব্দ, মেয়েকে শেষবার না-দেখেই গাড়ি ঘোরালেন রবীন্দ্রনাথ

/৯

সমস্ত শোকের মধ্যে সবচেয়ে অসহনীয়, সবচেয়ে তীব্র সন্তানশোক। যাঁর আগে যাবার কথা, তিনি পড়ে রইলেন, আর তাঁর চোখের সামনে দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেল তাঁরই আত্মজ - এ কি সহ্য করা যায়? এ-শোক রবীন্দ্রনাথের জীবনে এসেছে তিনবার। আর আশ্চর্যভাবে, অমানুষিক মনোবল আর স্থৈর্যের সাহায্যে, তিনি বারবার এই বেদনাকে জয় করতে সমর্থ হয়েছেন।

/৯

১৯০৩ সাল। কবিপত্নীর মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই, কবির মধ্যমা কন্যা রেণুকা গুরুতর অসুখে পড়ল। আলমোড়ায় কন্যার শয্যার পাশে বসে, তার মনকে একটু প্রফুল্ল করার চেষ্টায় রবীন্দ্রনাথ খানকতক কবিতা রচনা করে শুনিয়েছিলেন। কদিন বাদে, মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় ফিরলেন কবি। কিছুদিনের মধ্যেই গতাসু হলেন রেণুকা।

/৯

বহু বছর পরে, নির্মলকুমারী মহলানবীশের কাছে কবি সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, "মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে আমাকে বললে- বাবা, পিতা নো'সি বলো। আমি মন্ত্রটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার শেষ নিঃশ্বাস পড়ল। তার জীবনের চরম মুহূর্তে কেন সে 'পিতা নো'সি' স্মরণ করল, তার ঠিক মানেটা আমি বুঝতে পারলুম।"

/৯

১৯০৭ সালে চলে গেল কবির কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ। পুজোর ছুটিতে বন্ধুপুত্র সরোজচন্দ্রের সঙ্গে মুঙ্গেরে বেড়াতে গিয়েছিল শমী। সেখানেই তার কলেরা হল। টেলিগ্রাফ পেয়ে কবি কলকাতা থেকে মুঙ্গেরে রওনা দিলেন, বোলপুর থেকে ভূপেন্দ্রনাথ কবির সঙ্গ নিলেন। মুঙ্গেরে শমীর মৃত্যু হল ৭ অগ্রহায়ণ। পাঁচ বছর আগে, ঠিক এই দিনটিতে কলকাতায় অকালে প্রয়াত হয়েছিল কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী।

/৯

মৃত্যুর সময় শমীর বয়স ছিল তেরো বছর মাত্র। সে বাবার বড়ো আদরের ছেলে, আকৃতিতে রবীন্দ্রনাথের অনুরূপ। এই শোক কবিকে নিদারুণভাবে আঘাত করেছিল, কিন্তু শোকের অসংযত প্রকাশ কোথাও নেই। কবির সেই নিরুদ্ধ শোক আধ্যাত্মিক সান্ত্বনারূপে নবকলেবর ধরে প্রকাশ পেয়েছিল সাহিত্যের অঙ্গনে।

/৯

বহু বছর পর, দৌহিত্র নীতীন্দ্রনাথের অকালপ্রয়াণে শোকস্তব্ধ কন্যা মীরাকে সান্ত্বনা দিয়ে একখানি পত্র লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লিখেছিলেন, "যে রাত্রে শমী গিয়েছিল সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসত্তার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক, আমার শোক তাকে একটুও যেন পিছনে না টানে।"

/৯

কয়েক বছরের মধ্যেই কবির জীবনে হানা দিল তৃতীয় সন্তানশোক। ১৯১৮ সালে কবির জ্যেষ্ঠা কন্যা বেলা কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মুমূর্ষু হলেন। তখন শান্তিনিকেতন থেকে বিষণ্ণ কবি রথীন্দ্রনাথকে পত্র লিখছেন, "জানি, বেলার যাবার সময় হয়েচে। আমি গিয়ে তার মুখের দিকে তাকাতে পারি এমন শক্তি আমার নেই।"

/৯

তাও, কিছুদিন বাদে মেয়েকে দেখতে কলকাতায় এলেন কবি। সন্তানকে শেষবার দেখার টান কি এড়ানো যায়? দুপুরের দিকে জামাতা শরৎচন্দ্রের বাড়িতে মেয়েকে দেখতে যাওয়া শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ। সেদিন ২ জ্যৈষ্ঠ (১৬ মে), মেয়ের বাড়ির কাছে যেতেই কান্নার আওয়াজ পেয়ে কবি বুঝলেন, যা ঘটার ঘটে গিয়েছে। তৎক্ষণাৎ গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন তিনি।

/৯

কন্যার মৃত্যুর পর, কবির একখানা কবিতার বই বেরিয়েছিল (আশ্বিন, ১৩২৫ বঙ্গাব্দ)। তার নাম 'পলাতকা', তাতে হঠাৎ চলে যাওয়া একগুচ্ছ মানুষের জন্য স্মৃতিকাতর বেদনার অশ্রু জমাট বেঁধে আছে। সেই বইয়ের একেবারে অন্তিম কবিতার নাম 'শেষ প্রতিষ্ঠা'। তাতে ধরা পড়েছে শোক, সান্ত্বনা ও শান্তি বিষয়ে কবির চরমবাক্য - এই কথা সদা শুনি, ‘গেছে চলে’, ‘গেছে চলে।/ তবু রাখি ব'লে/ব'লো না, ‘সে নাই।’

চিত্র ঋণ - আন্তর্জাল

Powered by Froala Editor