মহানগরী কলকাতার আইকন হলুদ ট্যাক্সি। অ্যাপক্যাব বা শাটল কারের রমরমা বাজার তো হালের। এখনও শহরের বুকের উপর দিয়ে ছুটে চলে প্রায় ২৬,০০০ হলুদ ট্যাক্সি। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে হাত তুলে ডাকলেই দাঁড়িয়ে যায় আর দ্রুত পৌঁছে যায় শহরের যে-কোনো প্রান্তে। ট্যাক্সি চালকদের দৌরাত্ম্য, খারাপ ব্যবহার - ইত্যাদি নানা বিষয়ের কথা বললেও ট্যাক্সিকে শহরবাসী এখনও নিজের মনে করে। কিন্তু এই ট্যাক্সির ইতিহাসের খবর আর কতজন রাখেন?
কলকাতায় প্রথম ট্যাক্সি আসে ১৯০৯ সালে। এখন যেখানে ফ্র্যাঙ্ক রস কোম্পানির ওষুধের দোকান, চৌরঙ্গী রোডের সেখানেই ছিল ফরাসি শেভিজাঁ কোম্পানির অফিস। তারাই কলকাতার পথে প্রথম ট্যাক্সি নামায়। চৌরঙ্গী থেকে ছেড়ে মিটারওয়ালা গাড়ি পৌঁছে যেত দমদম, ব্যারাকপুর, বজবজ। দুই সিলিন্ডারের ছোট্ট ‘charron’, গাড়িগুলোয় চেপে মাত্র দুজন যাত্রী যেতে পারতেন। মাইল প্রতি আট আনা ছিল ভাড়া। টকটকে লাল রঙের এই গাড়িই কলকাতায় ট্যাক্সির পূর্বপুরুষ।
এরপর কয়েক বছরের মধ্যেই ব্যবসায় নামে ইন্ডিয়ান মোটর ট্যাক্সি ক্যাব এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। যাত্রীরা ভালোবেসে ডাকত 'A' কোম্পানি। কারণ সব ট্যাক্সির নাম্বার শুরু হত 'A' অক্ষর দিয়ে। এদের ম্যালেন স্ট্রিটের গ্যারেজে ছিল ৮০-৯০টি ট্যাক্সি। প্রথমে বেশিরভাগ চালকই বাঙালি হলেও, পরে মূলত শিখদের এই কাজে নিয়োগ করা হয়।
ব্রিটিশ আমলের অনেক ব্যবসার মতোই স্বাধীনতার পর হারিয়ে যাচ্ছিল কলকাতা ট্যাক্সিও। আর তখনই ১৯৫৭ সালে হিন্দুস্তান মোটর কোম্পানি তৈরি করে অ্যাম্বাসেডর গাড়ি, যাতে অনায়াসে চারজন যাত্রী জায়গা করে নিতে পারেন। সেইসঙ্গে পিছনে ট্রাঙ্কে রাখা যায় মালপত্র, লাগেজ, এমনকি বড় বাক্স। কয়েক বছরের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই মডেল। আর খাবি খেতে খেতে বেঁচে যায় কলকাতার ট্যাক্সি। ট্যাক্সিগুলো রং ছিল কালো এবং হলুদ। কালো ট্যাক্সি শুধু শহরের মধ্যেই থাকত। আর হলুদ ট্যাক্সি চলে যেত শহর থেকে দূরে। তারপর কখন আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় কালো রঙের ট্যাক্সি। আর হলুদ ট্যাক্সি হয়ে ওঠে কলকাতার নস্টালজিয়া।
ট্রাফিক কন্ট্রোল বোর্ডের আপত্তি সত্ত্বেও হাতে টানা রিকশা, ট্রামের মতোই কলকাতার বুকের থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়নি হলুদ ট্যাক্সি। অ্যাপ ক্যাব, বাইক-ট্যাক্সির সাথে পাল্লা দিয়েও, বাজার যে খুব খারাপ তা বলা যাবে না। প্রতিযোগিতার বাজারে ঘটে গেছে বেশ কিছু ব্যাবসায়িক পরিবর্তন। আজকাল মিটার ট্যাক্সির থেকে অনেকেই প্রিপেইড ট্যাক্সি বেশি পছন্দ করেন। রাস্তা খুঁজতে ব্যবহার করা হয় স্মার্ট ফোন। বছর পাঁচেক আগে ব্যবসা গুটিয়েছে হিন্দুস্তান মোটর কোম্পানি। কিন্তু হলুদ রঙের অ্যাম্বাসাডর গাড়ি ধরে রেখেছে কলকাতার নস্টালজিয়া।
Powered by Froala Editor