যুদ্ধ করতে গিয়ে কেউ লুটে নিয়ে আসে রাজকোষের সোনাদানা। কেউ-বা শেষপাতে পায় পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা। হাল্লা রাজার সেনারা যুদ্ধ করতে গিয়ে পেয়েছিল মণ্ডা-মিঠাই। আর ডেনমার্ক-কানাডার সৈন্যরা এক বোতল করে হুইস্কি। অবশ্য তাকে ‘যুদ্ধ’ বলা ভুল হবে। একটা ছোট্ট দ্বীপ, গাছপালা নেই, প্রবল ঠান্ডা। মাঝেমধ্যে সেখানে যাও, নিজের দেশের ঝান্ডা পুঁতে চলে আসো। এই হল যুদ্ধ। আর এই দ্বীপ নিয়ে দু’দেশের টানাপোড়েন চলে প্রায় পঞ্চাশ বছর। যা বিখ্যাত হয়ে আছে ‘হুইস্কি যুদ্ধ’ (Whisky War) নামে।
তার জন্য যেতে হবে হান্স দ্বীপে (Hans Island)। গ্রিনল্যান্ড থেকে খানিক দূরে অবস্থিত এই ন্যাড়া দ্বীপটা নিয়েই যত কাণ্ড। মোটামুটি দেড় বর্গ কিলোমিটার মতো পরিধি। লোকজন না থাকলেও বহুকাল আগে গ্রিনল্যান্ডের একাংশের অধিবাসী মাছ ধরার কাছে ব্যবহার করতেন দ্বীপটিকে। একই উদ্দেশ্যে যাতায়াত ছিল কানাডার (Canada) একদল অধিবাসীরও। ১৯৭৩ সালে ইউনাইটেড নেশনের মাধ্যমে সীমান্ত নিয়ে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয় কানাডা আর ডেনমার্কের (Denmark) মধ্যে। এসে পড়ে সুমেরু অঞ্চলের এই দ্বীপটির প্রসঙ্গও। গ্রিনল্যান্ডের যে অঞ্চল ডেনমার্কের মধ্যে পড়ে তারই সীমানায় অবস্থিত দ্বীপটি। অন্যান্য বিষয় নিয়ে নানা মতান্তর থাকলেও এত ছোট একটি দ্বীপ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়নি কেউই। দু’পক্ষই এক্ষেত্রে ‘ধীরে চলো’ নীতি গ্রহণ করে।
গোল বাঁধে ১৯৮৪ সালে। হঠাৎই কানাডার একদল সেনা সেই দ্বীপে এসে পুঁতে দেয় নিজেদের পতাকা। পাশে রেখে যায় কানাডার বিখ্যাত হুইস্কি। খবর পৌঁছোয় ডেনমার্কের কাছে। সে দেশের গ্রিনল্যান্ড বিষয়ক মন্ত্রী ওই বছর আসেন হান্স দ্বীপে। ডেনিশ পতাকা উড়িয়ে পাশে রেখে দেন একটি চিঠি। যাতে লেখা, ‘ডেনমার্কের দ্বীপে স্বাগত জানাই’। ও হ্যাঁ, ডেনমার্কের সেরা পানীয় ‘স্প্যানপস’ রাখতে ভোলেননি তিনি। ব্যাস, শুরু হল ‘হুইস্কি যুদ্ধ’। কোনো গুলি চলেনি, রক্তপাত হয়নি। শুধু মাঝেমধ্যে একদল গিয়ে পতাকা পুঁতে রেখে আসত হুইস্কির বোতল। পর্যায়ক্রমে এই রেশারেশি চলতে থাকে দীর্ঘদিন। ২০০৫ সাল পর্যন্ত ৬ দফা চলেছে এই যুদ্ধ। চিঠিপত্র আদানপ্রদান হয়েছে বিস্তর। এর মধ্যে দু’দেশের কূটনীতিবিদদের মধ্যে বহুবার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। হাসাহাসি চলেছে যুদ্ধের পরিণাম নিয়ে। কিন্তু প্রতিযোগিতার মনোভাব থেকে সরে আসেনি কোনো দেশই।
অবশেষে ২০০৫ সালে সমঝোতায় আসতে রাজি হয় দু’পক্ষ। আধুনিক যুগে পতাকা পোঁতা আর হুইস্কি রেখে আসার মতো যুদ্ধ অত্যন্ত হাস্যকর একটি কাজ। সবচেয়ে বড়ো কথা, এই ধারাবাহিক টানপোড়েন যে ভবিষ্যতে বড়ো বিপদে পরিণত হবে না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। দু’দেশই নিজেদের পর্যবেক্ষক দল পাঠায় সেখানে। কিন্তু ‘যুদ্ধ’ বন্ধ হয়ে গেলেও, নমনীয় হতে চায়নি কেউ। ২০১৮-তে একবার দ্বীপটিকে কাল্পনিক দুটি ভাগে বিভক্ত করার প্রস্তাব এসেছিল। অবশেষে টনক নড়ে ২০২২-এ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর। তড়িঘড়ি জুন মাসে দ্বীপ ভাগাভাগির প্রস্তাবে সই করে দু’পক্ষ। কানাডার ওটোয়াতে গ্রিনল্যান্ড, ডেনমার্ক ও কানাডার মন্ত্রীরা একত্রিত হয়ে সমাপ্ত করে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের সীমান্ত সমস্যা। তারপর বিস্তর খাওয়াদাওয়া। শেষপাতে কী ছিল আর নিশ্চয়ই নতুন করে বলে দিতে হবে না?
আরও পড়ুন
আজও যুদ্ধবিধ্বস্ত দিনগুলির সাক্ষ্য বহন করে হুন্দেরমানের ‘স্মৃতির জাদুঘর’
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বর্বরতাকে প্রকাশ্যে এনেছিলেন যিনি