অসহায় লাগছে জাতিসংঘকেও। শান্তিপূর্ব মীমাংসার প্রস্তাব কার্যত খারিজ করেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল এবং গাজার হামাস গোষ্ঠী। কখনো চলছে আকাশপথে বোমাবর্ষণ। আবার কখনো উড়ে আসছে রকেটের ঝাঁক। আর আতঙ্কের মধ্যেই দিন গুনছেন সেখানকার বাসিন্দারা। মৃতের সংখ্যা ২১৩। যার মধ্যে রয়েছে চল্লিশেরও বেশি শিশু। আহত দেড় হাজারেরও বেশি। দুই পক্ষের মধ্যে এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থামার কোনো সম্ভাবনাই দেখতে পাচ্ছেন না আন্তর্জাতিক কূটনীতিবিদরা।
কিন্তু প্যালেস্তাইন এবং ইজরায়েলের এই বিবাদ আজকের নয়। তবে তার বীজ রোপণ হয়েছিল দু’ হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে। ইতিহাস তেমন কথাই বলে। ৯৫৭ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে ইজরায়েলে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা সলোমন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ অব্দে সেই মন্দির ধ্বংস করেছিলেন ব্যাবিলনিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাদরেজার। আর তার পর থেকেই শুরু হয় ইহুদি এবং আরবিয় ইসলাম সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। যদিও ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের জন্য দায়ী উনিশ শতকের শেষ দিকের ধারাবাহিক কিছু ঘটনা।
পঞ্চাদশ শতক থেকেই আরবের পশ্চিমাংশের বাসিন্দা ছিলেন ইসলাম ধর্মালম্বী মানুষেরা। মূলত বেদুইনদের সংসার ছিল সেখানে। জেরুজালেম ইহুদিদের পবিত্রভূমি হলেও, তাঁরা বসবাস করতেন ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে। তাছাড়া ইহুদিদের একটা বড়ো অংশ বাস ছিল রাশিয়াতে। উনিশ শতকের শেষে ইহুদি বিদ্বেষী রাজনৈতিক শক্তির কারণে তাঁরা ফিরে আসতে থাকেন মধ্যপ্রাচ্যে। গন্তব্য প্যালেস্তাইন। পবিত্র ভূমি জেরুজালেম উদ্ধার করাই লক্ষ্য হয়ে ওঠে তাঁদের। প্যালেস্তাইনে তখন অটোমান রাজত্ব। প্রথমদিকে ইহুদি অনুপ্রবেশে কোনো বাধা দেয়নি তারা। তবে ১৮৮০ সালের পর থেকেই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে নিয়মিত সংঘর্ষ লেগে থাকার কারণে শেষ পর্যন্ত অনুপ্রবেশ বন্ধ করে অটোমানরা। ততদিনে প্রায় ৭৫ লক্ষ ইহুদি অনুপ্রবেশ করেছে প্যালেস্তাইনে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাঁদের পরাজয়ের পরই অঞ্চলটির দখল নেয় গ্রেট ব্রিটেন। তবে ব্রিটিশ রাজও শান্তি বজায় রাখতে পারল না প্যালেস্তাইনে। হামেশাই সেখানে হিংসাত্মক রূপ নিত পরিস্থিতি। সংখ্যালঘু ইহুদিদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধত আরবিয়দের। দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছালে আন্তর্জাতিক স্তর থেকেই ব্রিটেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় প্যালেস্তাইনে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। তবে সমস্যা বাঁধল সেখানেও। প্যালেস্তাইন পূর্বপুরুষদের জন্মভূমি বলে দাবি করল ইহুদিরা। অন্যদিকে স্বাধীন ইসলাম রাষ্ট্র তৈরির আবেদন জানাল আরবিয়রা।
আরও পড়ুন
নিরাপদ নয় শরণার্থী শিবিরও, ইজরায়েলি হামলায় মৃত্যু এক পরিবারের ৮ শিশুর
এটা যে সময়ের কথা হচ্ছে, সেটা চল্লিশের দশক। গোটা বিশ্বজুড়েই তখন উত্তপ্ত হচ্ছে পরিস্থিতি। চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব। নাটকীয় মোড় নিল প্যালেস্তাইনের পরিস্থিতিও। ততদিনে জার্মানি, পোল্যান্ড-সহ একাধিক দেশে ইহুদিনিধন শুরু করে দিয়েছে হিটলার। ফলে প্রাণে বাঁচতে হাজার হাজার ইহুদি ইউরোপ থেকে শরণার্থী হিসাবে চলে আসতে থাকল মধ্যপ্রাচ্যে। সেইসঙ্গে আরও দৃঢ় হল তাঁদের মাতৃভূমি তৈরির সংকল্প।
আরও পড়ুন
ভয়াবহ যুদ্ধে রক্তাক্ত ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন, গাজায় মৃতের সংখ্যা কমপক্ষে ১১৯
বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরই ইহুদি এবং আরবিয়দের সংঘর্ষ ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। তার রেশ পড়ে ব্রিটিশ সরকারের ওপরেও। স্বাধীনতার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নেনন অনেক ইহুদিই। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের একটি ভোটে নির্ধারিত হয়, প্যালেস্তাইনকে ভেঙে দুটি পৃথক দেশ তৈরি হবে। আর জেরুজালেম পরিগণিত হবে আন্তর্জাতিক নগরী হিসাবে। ইহুদিরা এই প্রস্তাব মেনে নিলেও, মান্যতা দেয়নি আরবিয়রা। এই জটিলতার মাঝেই ১৯৪৮ সালে ঔপনিবেশিক রাজত্ব গুটিয়ে নেয় ব্রিটিশ। আর তারপরেই ইহুদি নেতারা ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের কথা গোষণা করে। বলাই বাহুল্য, জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে সেই রাষ্ট্রগঠন হয়নি। ফলে ব্রাত্য থেকে যায় আরবিয়দের দাবি।
আরও পড়ুন
ইজরায়েলের রাষ্ট্রপতি হওয়ার অনুরোধ, প্রস্তাব ফেরালেন আইনস্টাইন
অন্যদিকে, বিশ্বযুদ্ধের সময় ইজরায়েলে আশ্রয় নিয়েছিল ৭ লক্ষেরও বেশি ইহুদি। ফলে, আরও চরমে পৌঁছায় বাসস্থান সংকট। সেই ঘাটতি মেটাতেই ধীরে ধীরে অধিগ্রহণ শুরু করে ইজরায়েল। বাড়াতে থাকে তার পরিধি। ইজরায়েলের সেই ‘আগ্রাসনে’ বাসস্থান ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় হাজার হাজার আরবিয় প্যালেস্তিনি। রুখে দাঁড়ালেন অনেকেই। শুরু হল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে আরবিয়দের সাহায্যের জন্য সেসময় হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল মিশর, জর্ডন এবং তুরস্ক। কিন্তু সকলেই এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্যই।
বছরখানেক পরে যুদ্ধ শেষ হলে দেখা যায় প্যালেস্তাইনের অধিকাংশ অঞ্চলই দখল করে নিয়েছে ইজরায়েল। অন্যদিকে প্যালেস্তাইনের পশ্চিম তীর বা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের ক্ষমতা নিয়েছে জর্ডন। আর গাজায় আধিপত্য কায়েম করেছে মিশর। এমনকি জেরুজালেমও হাতের বাইরে চলে গেল প্যালেস্তাইনের। গোটা শহরটা ভাগ হয়ে গেল জর্ডন এবং ইজরায়েলের মধ্যে।
দু’দশকের মধ্যেই আবার রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্য। সামরিক অভিযান চালিয়ে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, গাজা এবং সম্পূর্ণ জেরুজালেম দখল করে ইজরায়েল। উল্লেখ্য গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেই মূলত আশ্রয় নিয়েছিল প্যালেস্তিনিরা। ইজরায়েল ক্ষমতায় আসার পর থেকেই অশান্ত হয়ে ওঠে গোটা অঞ্চলটি। আরবিয়দের ওপর অত্যাচার, নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায় তারপর থেকেই। আর এই ঘটনাই পরবর্তীতে জন্ম দেয় চরমপন্থী ইসলামিক সংগঠন হামাসের। সেটা ১৯৮৭ সাল। প্রকাশ্যেই হামাস ঘোষণা করেছিল, ইজরায়েলের ধ্বংসসাধনের মাধ্যমেই ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে তারা। কিন্তু সেই জঙ্গি গোষ্ঠী যে এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠবে তা কে জানত!
২০০৫ সালে প্যালেস্তাইনের নির্বাচনে অংশ নেয় হামাস। সকলকে চমকে দিয়েই সেই নির্বাচন জিতেও যায়। বা বলা ভালো, প্যালেস্তিনিদের ইহুদিভীতিই আইন পরিষদে জায়গা করে দেয় তাদের। ক্ষমতায় আসার দু’বছরের মধ্যেই পুনরায় সংঘর্ষ। সেই যুদ্ধে জিতে ২০০৭ সালে গাজার ক্ষমতা দখল করে হামাস। কিন্তু থেমে থাকেনি যুদ্ধ। বরং দৈনন্দিনের রূপ নেয় ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন বিরোধ। ২০০৮ সালে ইজরায়েলের সেনা-হামলায় মৃত্যু হয় সহস্রাধিক প্যালেস্তিনির। ২০১৪ সালের যুদ্ধে গাজায় মারা যায় দু’হাজারেরও বেশি মানুষ। উদবাস্তু হয়েছিলেন লক্ষাধিক। ইজরায়েলের পক্ষ থেকে অবশ্য জানানো হয়েছিল নিহতরা সকলেই জঙ্গি সংগঠন হামাসের সদস্য। তবে জাতিসংঘের রিপোর্ট অন্য কথাই বলে। ক্ষতিগ্রস্তদের ৯৫ শতাংশই সাধারণ মানুষ। যাঁদের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক নেই যুদ্ধের।
তারপর পরস্থিতি খানিক শান্ত হলেও, পুনরায় রণক্ষেত্র গাজা। এবার শেষ দেখে ছাড়তেই বদ্ধপরিকর দুই পক্ষই। আতঙ্কিত জাতিসংঘও। হামাস এবং ইজরায়েল—দুই তরফেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে সম্প্রীতির প্রস্তাব। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, এই দুই শক্তির ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে আর কত সাধারণ মানুষের মৃত্যু দেখতে হবে গাজাকে? উত্তর জানা নেই…
Powered by Froala Editor