প্রেম-পীরিতি ছেড়ে, বাঙালি ‘ভালোবাসতে’ শিখল কবে থেকে?

আবার সে এসেছে ফিরিয়া। বাঙালির নবীনতম উৎসব ভ্যালেন্টাইন’স ডে। অনধিকার চর্চা হলেও, ভালোবাসা নিয়ে দু-এক কথা বলা যাক। বাঙালি ঠিক কবে থেকে ভালবাসতে শিখল? আর তা খুঁজতে গিয়েই যা দেখলুম, তাতে একগাল মাছি। বাঙালি এই হালে ভালবাসতে শিখেছে। প্রাচীন যুগ তো বাদই দিন, এমনকি মধ্যযুগেও বাঙালি ভালবাসত না। খেয়াল করবেন, এতজন বৈষ্ণব কবি এত এত লাইন প্রেমের কবিতা লিখে মন আর চোখ ভরালেন, তাঁদের একজনও একটি লাইনেও ‘ভালোবাসা’ শব্দটা লিখলেন না!

তবে তাঁরা কী লিখতেন? লিখতেন মূলত প্রেম, প্রীতি আর তার চেয়েও বেশি ‘পিরীতি’। চণ্ডীদাস লিখেছেন,

‘কালিয়া প্রেমের মধু’ কিংবা

‘আমি তো দুঃখিনী, কুলকলঙ্কিনী/ হইনু করিয়া প্রীত’ অথবা

‘আপন সুখেতে করে যে পিরীতি/ তাহারে বাসিব পর’।

শেষ বাক্যটা মনে রাখবেন, পিরীতির সঙ্গে ‘বাসিব’ শব্দটাও আছে। ওটা আমাদের পরে কাজে লাগবে।

আরও পড়ুন
হলুদ রং, হাসিমুখ ও ‘এনার্জি সিক্রেট’ – স্মাইলির জন্ম ও বিশ্বজয়ের ইতিহাস

তাহলে ঠিক কবে ভালোবাসা এই পিরীতি-কে হটিয়ে দারুণভাবে আমাদের মনের কোমল পর্দায় রিনরিনে ধ্বনি তুলল? 

পাশাপাশি প্রেম বেশ গম্ভীর। সিরিয়াস-সিরিয়াস ব্যাপার। ‘হাবুদা আর পেঁচিদি পিরিত করে’, ‘হাবুদা আর পেঁচিদি ভালোবাসে’ আর ‘হাবুদা আর পেঁচিদি প্রেম করে’... বলে দেখুন লাস্টটা নিজের কানেই কেমন কেমন ঠেকবে। হাবু আর পেঁচি নাম থেকে গোটা স্পটলাইট প্রেমে গিয়ে পড়বে। আমাদের হোস্টেলে এক দাদা ছিল। মাঝে মাঝেই তাঁর প্রেমিকার ফোন আসত। সে তীব্র থমথমে মুখে ফিসফিস করে কীসব যেন বলত। একবার এক নভিস ‘কী হয়েছে দাদা? সিরিয়াস কিছু?’ বলাতে ‘দেখছিস না প্রেম কচ্ছি!’ বলে মুখঝামটা খেয়েছিল। প্রেম বড়ো সোজা জিনিস নয়কো! সাইকোলজিস্ট রবার্ট স্টেনবার্গ প্রেমকে তিনটি উপাদানের মধ্যে ভাগ করেছেন - আবেগ, অন্তরঙ্গতা আর সহানুভূতি। তাদের ভেঙে আবার সাত রকম হয়। সেই জটিলতায় নাই বা গেলাম।  

ভালোবাসা শব্দের কথা বলছিলাম। ভালোবাসার দুই অংশ - ভালো আর বাসা। এর মধ্যে ভালো শব্দটা আদৌ বাংলা না। হিন্দি বা মৈথিলী। স্বয়ং গুরুদেব লিখেছেন “‘ভালো' শব্দ ভদ্র শব্দজ, ‘বড়ো' বৃদ্ধ হইতে উৎপন্ন, ‘ছোটো' ক্ষুদ্র শব্দের অপভ্রংশ। মূল শব্দগুলির শেষবর্ণ যুক্ত - যুক্তবর্ণের অপভ্রংশে হসন্ত বর্ণ না হওয়ারই সম্ভাবনা।" সোজা কথায় ভালো আছি মানে ভদ্রস্থ আছি। ঠিকঠাক আছি। চলে যাচ্ছে। আর ‘বাসা’ শব্দ বাসনা-র উৎস। ১৩১৭ সালে সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় খগেন্দ্রনাথ মিত্র লিখেছেন "বাসি শব্দটিও এখন বাসি হইয়া গিয়াছে।”

আরও পড়ুন
১৫০ বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে ধ্বংসের দিন গুনছে চন্দ্রকোণার শীতলা মন্দির

যদিও বিক্রমপুর অঞ্চলের সম্ভাষণে ‘কেমন বাসতে আছেন?’ শোনা যায়। বাসা শব্দের মানে তাই ইচ্ছে, আকুতি। অর্থাৎ, ভালোবাসা মানে ভদ্রস্থ থাকার বাসনা। যা মোটামুটি সবার থাকে...

হায় রে! এদিকে কালে কালে তাঁর মানে এমন বদলেছে যে অভিধান খুললে ভালোবাসা মানে পাই ‘কোনো জিনিস বা ব্যক্তি-বিশেষকে প্রাণাধিক বলে জ্ঞান করা; মনোমত মনে করা; প্রীতি, স্নেহ বা শ্রদ্ধা করা...’

এখানেই শেষ করা যেত। কিন্তু করব না; বাসা নিয়ে আর দু চারটে কথা বলবই। চণ্ডীদাসে ফেরা যাক -
১। ‘তোমরা মোরে ডাকিয়া শুধাও না প্রাণ আনচান বাসি’
২। ‘কে সাজাল হেন সাজে হেরি বাসি দুখ’
৩। ‘পরাণ অধিক বাসে’
৪। ‘কহিতে বাসি যে ভয়’

আরও পড়ুন
১১৪ বছরের ইতিহাসে ইতি, বন্ধ হল ভাটপাড়ার রিলায়েন্স জুটমিল

ভদ্রলোক করেছেনটা কী! আনচান বেসেছেন, দুখ বেসেছেন। অধিক বেসেছেন, পর বেসেছেন আবার ভয়ও বেসেছেন? (যদিও ভালবাসেননি)। রবি ঠাকুর ‘বাসিব’ ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেছেন ১২ বার কিন্তু তাতে ১২ বারই ভালবেসেছেন। মাত্র একবার ‘ভগ্নহৃদয়’এ পাই ‘ভালো আমি বাসি তোরে/ চিরকাল বাসিব রে’ যেখানে একবার মাত্র ভালো বাদে বাসা ক্রিয়াপদের উল্লেখ আছে। 

ভালোবাসা থেকে প্রেমে এলে ব্যাপারটা আরও ঘাঁটা। ইংরাজিতে প্রেম মানে লাভ। এই লাভের গুড়ের সন্ধান করতে গিয়ে দেখি ওমা! সংস্কৃত ‘লুভ্যাতি’ বা যা প্রলোভন দেখায় তা থেকেই জার্মান লুফু হয়ে ইংরাজিতে লাভ এসেছে। সোজা কথা বাংলায় যা লোভ, ইঙ্গ ভাষায় আদতে সেটাই লাভ। খেয়াল করে দেখুন লিবিডো শব্দটাও কিন্তু সেই লোভ বা আকাঙ্ক্ষার দিকেই আঙুল দেখাচ্ছে। তাই প্রেম শব্দে এক তীব্র যৌন ইঙ্গিত শুরু থেকেই ছিল, যার কণামাত্র ভালোবাসায় নেই। এর একটা পাথুরে প্রমাণ দেওয়া যাক। ‘রজকিনী প্রেম’ যে ‘নিকষিত হেম’ আর তাতে একফোঁটাও কামগন্ধ নেই, সেটা কবিকে ব্যাখ্যা করে বলে দিতে হয়েছিল। ভালোবাসা-র বেলায় এই ব্যাখ্যা লাগেনি। রবি ঠাকুর নিজে কোনদিকে ছিলেন? অবশ্যই প্রেমের দিকে। সারাজীবনে তিনি যা লিখেছেন তাতে প্রেম শব্দটা ছিল ১২৬৯ বার। আর ভালোবাসা? মাত্র ৪৬১ বার। ‘ভালোবাসি’ যোগ করলে সংখ্যাটা আরও ২৭৭ বাড়বে। ‘ভালোবাসো’ মাত্র ২৪ বার, তাই উপেক্ষাই করলাম।       

যাই হোক। মরালটা কী দাঁড়াল? ভালো বাদ দিলেও বাসা যায়। আর তাই ‘সব সত্যি’। কবিতাবাসা সত্যি, গল্পবাসা সত্যি, প্রবন্ধবাসাও হয়তো।  ভাগ্যিস ফেসবুক ছিল না। তাহলে বিদ্যাপতি, বড়ু চণ্ডীদাস আর জুনিয়ার নরহরি সরকার, বাসু ঘোষ, লোচন দাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাসকে একেবারে ট্রোল করে করে মেরে দিত!

Powered by Froala Editor