শেক্সপিয়র বলেছেন,
“What's in a name? that which we call a rose
By any other name would smell as sweet.”
অর্থাৎ “নামে কি এসে যায়। গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক সে গন্ধ দেবেই।” স্কুলে গেছেন অথচ পিথাগোরাসের নাম শোনেননি, এমন অজ্ঞ-বিজ্ঞ কোনো দেশেই নেই। পিথাগোরাসের উপপাদ্য পিথাগোরাসের সৃষ্টি হোক বা না হোক -
১. এটি গণিতের সবথেকে বিখ্যাত বিবৃতি
২. এটি পৃথিবীর চতুর্থ সুন্দর সমীকরণ
৩. এই উপপাদ্যটির ৩৭১ এর বেশি প্রমাণ আছে। ই এস লুমিস এই সব প্রমাণ একত্রিত করেছেন তাঁর ‘পিথাগোরাস উপপাদ্য’ বইটিতে।
৪. এর প্রমাণে মাথা ঘামিয়েছেন ১২ বছর বয়সী নিউটন থেকে শুরু করে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট গারফিল্ড সহ অগণিত গণিত অনুরাগী।
না, কোনো গাণিতিক প্রমাণ বা আলোচনা এই প্রবন্ধে নেই, শুধু ওয়েলসের টাইম মেশিনে চেপে একবার ঘুরে আসা যাক যিশুখ্রিস্টের জন্মের ২০০০ বছর পূর্বে। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরে মেসোপটেমিয়ায় (বর্তমান ইরাক) যে ব্যাবিলিয়নীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। ব্যাবিলিয়নরা যে পিথাগোরিয়ান ট্রিপলেটের (অর্থাৎ যেসব পূর্ণসংখ্যা পিথাগোরাসের উপপাদ্যকে সিদ্ধ করে; যেমন (3, 4, 5) একটি পিথাগোরিয়ান ট্রিপলেট। কারণ 3^2+4^2=5^2 ব্যবহার জানতেন, তা জানা যায় ব্যাবিলিয়নদের ব্যবহৃত ক্লে ট্যাবলেট থেকে। সুলবা সূত্র থেকে জানা যায় ভারতীয়দের মধ্যেও বৌধায়ন, আপস্তম্ব, কাত্যায়ন প্রমুখ পিথাগোরাসের উপপাদ্যটি বিভিন্ন ভাবধারায় প্রকাশ করেছেন খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ বছর আগে।
অর্থাৎ পিথাগোরাসের উপপাদ্যের ধারণা এবং পিথাগোরিয়ান ট্রিপলেটের ব্যবহার হিন্দু গণিতবিদদের কাছে খ্রিস্টের জন্মের ৮০০ থেকে ৫০০ বছর আগে থেকেই ছিল। বিখ্যাত ভারতীয় গণিতজ্ঞ ভাস্করাচার্য তাঁর ‘লীলাবতী’ গ্রন্থে পিথাগোরিয়ান ট্রিপলেটের উল্লেখ করেছেন নানাবিধ প্রশ্নের মাধ্যমে। দিয়েছেন উপপাদ্যটির প্রত্যক্ষ প্রমাণ। যার একটি স্কুলপাঠ্য। অন্যদিকে গ্রিক দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ পিথাগোরাসের জন্ম খ্রিস্টের জন্মের ৫৭০ বছর পূর্বে। তাঁর কাছে ‘সংখ্যাই সব’, জীবনের প্রতিটি গতিপ্রকৃতি সংখ্যার ছন্দে বাঁধা। বর্তমান দক্ষিণ পূর্ব ইতালিতে তাঁর দর্শনে প্রভাবিত স্কুল ‘দ্য সেমি সার্কেল অফ পিথাগোরাস’ বা পিথাগোরিয়ান স্কুল নামে পরিচিত ছিল।
পিথাগোরিয়ান স্কুলে হত আধা ধর্ম আর আধা বিজ্ঞানের চর্চা। বেশিরভাগ মতামত মুখে মুখে প্রচারিত ছিল, লিখিত তত্ত্বের প্রসার সেভাবে ছিল না। স্কুলের সদস্যদের গোপনীয়তা ছিল অদ্ভুত, যা পিথাগোরাসকে করেছে আরও রহস্যময়। পিথাগোরিয়ানদের বিশ্বাস ছিল শুধু পূর্ণ সংখ্যায়, আর তাদের সরল অনুপাতে। তারা পূর্ণ সংখ্যায় ঈশ্বরের আশীর্বাদ দেখত। তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হল বর্গক্ষেত্রের কর্ণের দৈর্ঘ্য। এটি আবার একটি অমূলদ সংখ্যা। যা তাদের ঈশ্বর দর্শনের বিরোধী। তাই গোপনীয়তা বজায় রাখতে পরস্পর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল যে অমূলদ সংখ্যার ধারণা তারা বাইরে কাওকে জানাবে না। হিপ্পাসুস নামে একজন পিথাগোরিয়ান শিষ্য এ-কথা বাইরে প্রকাশ করলে তাকে মাঝ সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। পিথাগোরাস নিজেও ‘দ্য সেমি সার্কেল অফ পিথাগোরাস’ এর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর সদস্যদের হাতে খুন হয়ে যান। কেউ বলেন তিনি আত্মহত্যা করেন।
খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে ইউক্লিড ছিলেন আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ গ্রিক গণিতজ্ঞ। তাঁকে ‘জ্যামিতির জনক’ বলা হয়। তাঁর ‘এলিমেন্টস’ গ্রন্থে পিথাগোরাসের উপপাদ্যের ২টি পৃথক প্রমাণ দেন। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দে গ্রিক গণিতবিদ ডায়োফানটাস গণিতের অমূল্য অবদানগুলি একত্রিত করে ১৩টি খণ্ডে ‘এরিথমেটিকা’ নামে একটি বিশাল গ্রন্থ লেখেন। এর মধ্যে পিথাগোরাসের উপপাদ্য ও পিথাগোরিয়ান ট্রিপলেটের বিস্তারিত বর্ণনা আছে। আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত লাইব্রেরিতে সেটি সংরক্ষিত ছিল। মিশরের রানি ক্লিওপেট্রার সঙ্গে জুলিয়াস সিজারের যুদ্ধ বাঁধলে সিজার রানির নৌবহরে আগুন লাগিয়ে দেন। সেই আগুন ছড়িয়ে পরে সংলগ্ন লাইব্রেরিতে, নষ্ট হয়ে যায় সভ্যতার মহামূল্যবান গ্রন্থ। এরিথমেটিকার সাতটি খণ্ড নষ্ট হয়, বেঁচে যায় ৬টি খণ্ড। পরে অবশ্য ক্লিওপেট্রার প্রেমিক আ্যন্টনি লাইব্রেরি পুনর্নির্মাণ করে এরিথমেটিকাকে সংরক্ষণ করেন।
এসব ঐতিহাসিক তথ্য, ঘটনা পরম্পরা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, পিথাগোরাসের জন্মের বহু আগে থেকেই ঐ উপপাদ্যটির নানারূপে অস্তিত্ব ছিল এবং তার প্রমাণ ও অজানা ছিল না। ইতিহাসে এমন কোনো উপাদান নেই যা থেকে বলা যাবে পিথাগোরাস উপপাদ্যটি নিজে লিখেছেন। বরঞ্চ এটা বলা সঙ্গত যে তাঁর অনুগামীরাই বারংবার দাবি করে সিদ্ধ করেছেন উপপাদ্যটি পিথাগোরাসেরই। যা আসলে খ্রিস্টের জন্মের ১০০০ বছর আগেই কোনো এক অজ্ঞাতনামার অসামান্য গণিত কল্পনা। তাই গণিতের সবথেকে বিখ্যাত উপপাদ্যের মতো নামকরণটিও গণিতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফ্যালাসি।
আরও পড়ুন
১ মিনিটে ১৯৬টি অঙ্কের সমাধান, গিনেস বুকে নাম তুলল ১০ বছরের কিশোর
তথ্যসূত্রঃ
১. বি র্যাটনের ‘পিথাগোরাসঃ এভরিওয়ান নোজ...’, জার্নাল অফ টার্গেটিং, মেজারমে্ন্ট এন্ড আ্যনালিসিস ফর মার্কেটিং, (২০০৯) ১৭, ২২৯–২৪২।
২. ই মাওর, দ্য পিথাগোরিয়ান থিয়োরেম, এ ৪০০০-ইয়ার হিস্ট্রি, প্রিন্সটন এন জে, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, (২০০৭)।
আরও পড়ুন
নিরক্ষর ক্রীতদাস তিনি, অঙ্কের জাদুতে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সবাইকে
৩. উইকিপিডিয়া।
Powered by Froala Editor