১৪১, এস এন ব্যানার্জি রোড। ধর্মতলার এই ঠিকানায় প্রথমবার গেলে হয়তো কেউ কিছুই বুঝতে পারবে না। আশেপাশে আধুনিক সব দোকান। তারই মাঝে দাঁড়িয়ে আছে হাড়গোড় বের করা একটা বাড়ির অংশ। এই লকডাউনের পরিস্থিতিতে তার যে কী অবস্থা, কেউ জানে না। একদিন এখানেই দাঁড়িয়েছিল কলকাতার এক ইতিহাস। কলকাতার ইতিহাস? বলা ভালো, ইতিহাসের কলকাতার একমাত্র আশ্রয়দাতা। পুরনো কলকাতাকে বুকে আগলে রেখেছিল এই বাড়িটি। কর্পোরেশনের হলুদ সাইনবোর্ড হয়তো আজও সেই মুছে যাওয়া সময়ের চিহ্ন ধরে আছে। সশরীরে না থাক, গল্পের পাতায় আর স্মৃতিকথাতেই ধরা থাক বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড। যে নামটির মধ্যেই বেঁচে উঠেছিল পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ফটোগ্রাফিক স্টুডিও…
ফটোগ্রাফি যাঁদের প্রেম, আর পুরনো কলকাতা চর্চা যাঁদের মজ্জায়— তাঁরা কোনদিনও ভুলতে পারবেন না ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের কথা। ধর্মতলার অন্যতম ল্যান্ডমার্ক এই দীর্ঘ বাড়িটি তখন রীতিমতো ধুঁকছে। ব্যবসায় ক্রমশ মন্দা, আর্থিকভাবে ভেঙে পড়েছে সংস্থাটি। জমি নিয়েও চলছে টানাপোড়েন। শেষমেশ সব ঐতিহ্য থামিয়ে বন্ধ হল দেউটি। কলকাতা, ভারত কেন, বিশ্বের বহু সংবাদমাধ্যমে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। হায় রে মানুষ! এই গুরুত্বটাই যদি বছর কয়েক আগে থেকে দেওয়া শুরু করত, তাহলে বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ডের এমন পরিণতি দেখতে হত না। আশেপাশে গজিয়ে ওঠা আধুনিক ক্যামেরা ও ছবির জগত তখন বেশি আকর্ষণীয়। সাদা-কালোর আকর্ষণ বৃদ্ধ হয়ে পড়েছে…
এই সাদা-কালোর জমানারই এক সব পেয়েছির আসর হয়ে উঠেছিল বাড়িটি। স্বয়ং ফেলুদাকেও গডউইন পরিবারের পুরনো ছবির হদিশ পেতে এখানে আসতে হয়েছিল। এরকম বহু ফেলুরই শেষ ঠিকানা ছিল বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড। গল্পটা শুরু হয় ১৮৬৩ সালে। চার্লস শেফার্ড এবং স্যামুয়েল বোর্ন নামের দুই সাহেব একসঙ্গে মিলে এই বাড়িতে চালু করেন এই প্রতিষ্ঠান। এর সমান্তরালে উঠে আসবে আরও দুটো গল্প। ১৮৪৩ সালে স্যামুয়েল বোর্ন এদেশে উইলিয়াম হাওয়ার্ড নামের এক ফটোগ্রাফারের সঙ্গে মিলে একটি স্টুডিও খুলেছিলেন। নাম ছিল ‘বোর্ন অ্যান্ড হাওয়ার্ড’। পরে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন শেফার্ড। হাওয়ার্ড ব্যবসা ছেড়ে দিলে নাম বদলে হয়ে যায় ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’। প্রায় ওই সময়ই আজকের ১৪১, এস এন ব্যানার্জি রোডে বিশাল বাড়িটি নির্মাণ করেন হাওয়ার্ড। নাম ছিল ‘ক্যালকাটা ফটোগ্রাফার’। অনেকের স্মৃতিতে ঝলক দিয়ে উঠবে বাড়ির সামনের অংশের ছবিটি। নিচে লেখা ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’, আর বাড়িটির একদম ওপরে লেখা ‘photographer’। আজ এসব সুখস্মৃতিই বটে।
প্রকৃতপক্ষে বাড়িটি ছিল ভারতের সাদা-কালো ছবির ভাণ্ডার। নিজে তো ইতিহাসের অঙ্গ; ভেতরেও যত্নে সাজিয়ে রাখা এক একটি ইতিহাস। প্রথমে ভারতে আগমনরত ব্রিটিশদেরই ছবি তোলা হত এখানে। সঙ্গে থাকত দেশীয় রাজাদের ছবি। ধীরে ধীরে পরিধি বাড়ে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে পুরনো কলকাতার শতাধিক ছবি আছে। যার সিংহভাগই তোলা বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ডের। ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলার ছবি থেকে শুরু করে রামকৃষ্ণদেবের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে তোলা পোট্রেট, পঞ্চম জর্জের ভারত আগমন, ‘জাঙ্গল বুক’ স্রষ্টা রুডইয়ার্ড কিপলিং, — ভারতের ছবির আর্কাইভে পরিণত হয় এই প্রতিষ্ঠানটি। সাধারণ থেকে অসাধারণ, সবাই জায়গা পেয়েছে এখানে। হাজার হাজার নেগেটিভের এক উজ্জ্বল কালেকশন।
আরও পড়ুন
১৩৭ বছর আগে তোলা এই ছবিই ঘূর্ণিঝড়ের সর্বপ্রথম ফটোগ্রাফ
দেশে স্বাধীনতা চলে আসার পরও কয়েক বছর ব্রিটিশ সাহেবরা প্রতিষ্ঠানটি চালায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৪ সালে বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ডের মালিকানার জন্য নিলামের আয়োজন করা হয়। সেখানেই সোনার সুযোগ ছিনিয়ে নেন আজমির এবং জয়ন্ত গান্ধী নামের দুই ফটোগ্রাফার। শেষ দিন পর্যন্ত যারা যুক্ত ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এত বড়ো আর্কাইভ যত্নে রেখেছিলেন তাঁরা। বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ডের ছবিগুলির সবথেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য ছিল, ছবিগুলি কখনও পুরনো হত না। দামি কেমিক্যাল আর কাগজে ফুটে উঠত সাদা-কালো ছবিগুলি। এই সাদা-কালোই এদের মূল ভিত্তি ছিল। পরবর্তীতে প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে; মেমোরি কার্ড, ডিজিটাল ক্যামেরার যুগও এসে গেছে। কিন্তু বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড তাদের চিরাচরিত সাদা-কালোত্ব বজায় রেখেছে। সেই আভিজাত্যের গর্বই প্রতিষ্ঠানটিকে বিশ্বের মানচিত্রে নিয়ে এসেছিল।
আরও পড়ুন
ডাউন সিনড্রোমকে হারিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি তরুণ ফটোগ্রাফারের
কিন্তু খারাপ সময় শুরু হলে মানুষ কেন, যে কেউই ঝাঁঝরা হয়ে যায়। সালটা ১৯৯১। হঠাৎ আগুন লেগে গেল পুরনো বাড়িটায়। মাথায় হাত প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের। এতদিনের ইতিহাস, আর্কাইভ— অধিকাংশই ছাই হয়ে যায়। তখন সরকারের তরফ থেকে ক্ষতির পরিমাণ জানতে চাওয়া হয়েছিল। শেষের দিনগুলোয় কর্মীরা দুঃখ করে বলতেন, সেই শেষবার কেউ খেয়াল নিল আমাদের। বাকি গল্প ছিল বঞ্চনার। লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানির সঙ্গে মালিকানা সংক্রান্ত একটি মামলা চলছিল বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড কর্তৃপক্ষের। সেই মামলায় হারই কফিনে শেষ ‘ফুল’টি দিয়ে গেল। ২০১৬ সালে থেমে গেল একটা চলমান গল্প। হঠাৎ করেই সবার মনে পড়ল প্রতিষ্ঠানটির কথা। স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েন অনেকে। আফসোস, সময় তখন বহু স্রোত এগিয়ে গেছে। এভাবেই হয়তো থেমে যেতে হয়। ময়দান থেকে অবসর নিতেই হত একদিন না একদিন। হয়তো আরও নতুনভাবে ফিরে আসা যেত। কিংবা, যদি একটা ১৯৯১ না আসত! অনেক কিছুই হতে পারত, হল না। বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড আজ শুধু স্মৃতির একটা নাম। ভুলে যাওয়া পাতা ওলটানোর মতো যাকে একটু পড়া যায়; কিন্তু ছোঁয়া যায় না…
আরও পড়ুন
গম্ভীর মুখ থেকে সবাইকে হাসিয়েছিল ক্যামেরা, সেখান থেকেই শুরু ‘সে চিজ’-এর যাত্রা
Powered by Froala Editor