ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে যেমন জুড়ে গেছে বহু স্থান, তেমনই জুড়ে আছে বেশ কিছু তারিখও। তেমনই একটি হল ১৯১৯-এর ১৩ এপ্রিল। আনন্দের বা বিপ্লবের নয়, দুঃখের দিন। এই দিনেই জালিয়ানওয়ালাবাগের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ কয়েক মিনিটে বদলে গিয়েছিল আর্তনাদে। হাজার হাজার রক্তাক্ত দেহের জায়গায় আজ গড়ে উঠেছে স্মৃতিস্তম্ভ। সেই জালিয়ানওয়ালা বাগে আজ পর্যটকদের ভিড়। কিন্তু যতবারই যাই, একবারও কি মনে পড়ে একজন বাঙালি ডাক্তারের কথা? যার জন্য এই জায়গায় জালিয়ানওয়ালাবাগ মেমোরিয়াল স্থাপিত হল? সেদিনের ডাক্তার শশীচরণ মুখোপাধ্যায় নিজেও ছিলেন সেই মাঠে। তিনি সেই মানুষদের একজন, যাঁদের গায়ে গুলি এসে লাগেনি।
আরও পড়ুন
প্রেম নিবেদনের কয়েকদিন পরেই ফাঁসি, ১০ বছর ‘ফিরে আসা’র অপেক্ষায় ছিলেন কল্পনা
বংশানুক্রমিকভাবে মেমোরিয়ালের দায়িত্বে আছেন বাংলার এই মুখার্জি পরিবার। কিন্তু শুরু হয়েছিল সেই ১৯১৯-এর বিশেষ দিনটিতে। হুগলীর ডাক্তার শশীচরণ প্র্যাকটিসের জন্য চলে গিয়েছিলেন এলাহাবাদ। সেই সময়ই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয় মদন মোহন মালব্য’র। রাওলাট আইনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ হচ্ছে দেশের সর্বত্র। তখন মালব্যের নির্দেশে অমৃতসরে চলে যান ডাঃ মুখার্জি। কংগ্রেসের অধিবেশনের জন্য জমি দেখার কাজে পাঠানো হয় তাঁকে।
আরও পড়ুন
কলকাতার কেবিনগুলিতে বসত বিপ্লবীদের বৈঠক, ছিল পালানোর গোপন পথও
১৯১৯, ১৩ এপ্রিল। দিনটি ছিল বৈশাখী। পাঞ্জাবী নববর্ষের দিন। পবিত্র একটি দিনে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামের একটি পার্কে হাজির হন ৫,০০০ মানুষ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শশীচরণও। পার্কটা একটু অদ্ভুত ধরণের। চারিদিক ঘেরা, শুধু একটাই রাস্তা আছে বাইরে বেরনোর। প্রতিবাদ চলছিল শান্তিপূর্ণভাবেই। মানুষগুলোও ছিল নিরস্ত্র। হঠাৎই চলে এলেন জেনারেল ও’ডায়ার। এর পরের অংশটি প্রত্যেকের জানা। টানা ১০ মিনিটের ফায়ারিংয়ে মারা যান ১,৫০০ মানুষ। পবিত্র দিনে লেগে যায় তাজা রক্তের দাগ। কেউ গুলিতে মারা পড়েন, কেউ পার্ক মধ্যস্থ কুয়োয় ঝাঁপিয়ে পড়েন।
আরও পড়ুন
৭২ বছর পরে রূপকথার মিলন স্বাধীনতা সংগ্রামী আর তাঁর হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীর
যে মানুষগুলো বেঁচে গিয়েছিল, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হুগলীর ওই ডাক্তার। ভাগ্যবান? এরপরের ইতিহাসও প্রায় সবারই জানা। কিন্তু আরও একটি ঘটনা ঘটে পরে। ওই জালিয়ানওয়ালা বাগে ব্রিটিশরা একটি মার্কেট খুলতে চেয়েছিল। আড়ালে চিন্তা ছিল ওই জায়গাটাকে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া। কিন্তু সেটা হয়নি। আর এর পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী যে মানুষটি, তাঁর নাম ডাঃ শশীচরণ মুখোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন
স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর পাকিস্তানের নাম মুছল বাংলাদেশ
পার্ক দখল করতে পারে ব্রিটিশরা, জানার পরেই সঙ্গে সঙ্গে তিনি চলে যান মহাত্মা গান্ধীর কাছে। জাতীয় কংগ্রেসের কাছেও পিটিশন দাখিল করেন। ১৯২০-তে সেটা মঞ্জুরও হয়। জমির দাম ঠিক করা হয় সাড়ে ছয় লক্ষ টাকা! অবশ্য সেই সঙ্গে শশীচরণকে গ্রেফতারও করা হয়। কিন্তু লাভ হয়নি; ছাড়া পেয়ে যান তিনি। এরপর বাড়ি বাড়ি টাকা চাইতে বেরোন তিনি। একটাই উদ্দেশ্য, ব্রিটিশদের এই পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিতে হবে। তিনি যে সামনে থেকে দেখেছেন সেই নৃশংসতা!
আরও পড়ুন
পুলিশের হাতে গ্রেফতার এড়াতে, পিস্তলের শেষ বুলেট মাথায় গেঁথে নিলেন চন্দ্রশেখর
টাকা জোগাড়ও হয়ে গেল একসময় - ৯ লক্ষ টাকা! ওই জমি কিনে নিলেন ডাঃ শশীচরণ মুখার্জি। নিলামেও রাখা হল। পরে জালিয়ানওয়ালাবাগের ওই মাটিতেই তৈরি হল মেমোরিয়াল। আজ অমৃতসরে গেলে যেখানে প্রায় প্রত্যেকেই একবার না একবার যাই, সেটা তৈরিই হত না এই মানুষটি না থাকলে…
আরও পড়ুন
ভাষাভিত্তিক রাজ্য চাই, ৫৮ দিন অনশনের পর মৃত্যু স্বাধীনতা সংগ্রামীর
প্রথম সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ডাঃ শশীভূষণ। পরবর্তীতে তাঁর ছেলে উত্তমচরণ ও বর্তমানে নাতি সুকুমার মুখার্জি এর দায়িত্বে। জালিয়ানওয়ালারবাগের রক্তের নিচে এরকম কত মানুষ চাপা পড়ে আছেন। ডাঃ শশীচরণ মুখার্জি’র মতো মানুষরাও তো ইতিহাসের এক অংশ। তাঁদের কথাও যাতে আমরা সবাই জানতে পারি, তারই প্রচেষ্টা করা হোক সব মহল থেকে।
Powered by Froala Editor