কলকাতার ‘পাথুরে গির্জা’য় একান্তে বসে থাকেন হেস্টিংস, প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে জোব চার্নক

ডালহৌসির ব্যস্ত অফিসপাড়া। তবে সেখানে কেবল ব্যস্ততা আর আপিসের ডেডলাইনের গল্পই নেই। বরং এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস। যার কিছুটা আমরা জানি, কিছুটা জানি না। সেই ইতিহাসের পরশ ধরতেই আমাদের বেরিয়ে পড়া। অফিসযাত্রীদের ভিড়, পর্যটকদের হাঁকডাক সরিয়ে একটু শান্ত হয়ে পুরনো গন্ধ মেখে নেওয়া যাকে বলে।

ঘুরতে ঘুরতে প্রথমেই চোখ গেল একটা লম্বা উঁচু পিরামিডের মতো মিনারের দিকে। বোঝা গেল, এটিই সেই সেন্ট জন’স চার্চ। কলকাতার পুরনো স্থাপত্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই চার্চ যত না বিখ্যাত, ততই বিখ্যাত এর ভেতরের সমাধি প্রাঙ্গণ। ব্রিটিশ ভারতের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বদের সমাধি রয়েছে এখানে। আর চার্চ? সেটা কি কোথাও হারিয়ে যায় আমাদের কথার মাঝে?

এই কথা ভাবতে ভাবতেই ঢুকে পড়া গেল। শীতের সকালের রোদ নেমে এসেছে। আরও যেন মোহময়, পবিত্র দেখাচ্ছে গির্জাটিকে। ভাবছে অতীত দিনের কথা। সালটা ১৭৮৪। শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা নবকৃষ্ণ দেব এই জমিটি দান করেছিলেন। এটা সেই সময়, যখন কলকাতা ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন মসনদে। শহরটাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা তাঁদের। তারই অংশ হিসেবে তৈরি শুরু হল এই সেন্ট জন’স চার্চের। কলকাতার প্রথম অ্যাংলিকান ক্যাথিড্রাল। ১৮৪৭ সালে সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল তৈরি হওয়ার আগে পর্যন্ত এটিই ছিল একমাত্র ক্যাথিড্রাল চার্চ।

১৭৮৪ সালে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। এমনকি আজও, চার্চের ভেতর একটা কক্ষে রাখা রয়েছে হেস্টিংসের ব্যবহৃত চেয়ার। রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত অন্যান্য সামগ্রীও। ১৭৮৭ সালে মাথা তুলে দাঁড়ায় সেন্ট জন’স। ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্টদের বিরোধ নয়, বরং তাঁদের মধ্যে সমন্বয়কারী হিসেবেই রয়েছে এই অ্যাংলিকান চার্চ। আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে স্বমহিমায়, ঐতিহ্যে।

গোটা গির্জাটাই পাথরের তৈরি। এক সময় এর জন্যই একে ‘পাথুরে গির্জা’-ও বলা হত। গির্জার মাঝে রয়েছে সেই বিশেষ পিরামিডাকার গঠনটি, যেটা দূর থেকে দেখেই চিনে নেওয়া যায়। গির্জার ভেতর রয়েছে বিদেশি বহু চিত্রকরদের আঁকা ছবি। রয়েছে জার্মান চিত্রশিল্পী যোহান জোফানির আঁকা ‘লাস্ট সাপার’-এর ভার্সন।

এ তো গেল চার্চের কথা। কিন্তু প্রায় ২৩০ বছর অতিক্রান্ত এই বৃদ্ধের আঙিনাতেও ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। সেই যে বলা হচ্ছিল, সমাধিক্ষেত্র। দুই কন্যা-সহ জোব চার্নক, গভর্নর লর্ড ব্রেবোর্ন, বেগম ফ্রান্সিস জনসন— কত জনের শেষের ঠিকানা হয়েছে এই চার্চ প্রাঙ্গণ। রয়েছে লেডি ক্যানিংয়ের স্মৃতিসৌধ। আর ব্ল্যাক হোল মনুমেন্ট তো কিংবদন্তির পর্যায়ে চলে গেছে।

এভাবেই চলতে থাকে সময়, চলতে থাকে ইতিহাস। সেন্ট জন’স চার্চ সেই ইতিহাসেরই একটা জীবন্ত অংশ হয়ে রয়ে গেছে। গরিমা হয়তো কমেছে, কিন্তু ঐতিহ্য? সেটাতে বোধহয় ভাটা পড়েনি।

Powered by Froala Editor

Latest News See More