সরস্বতী পুজো নাকি বাঙালির 'ভ্যালেন্টাইন্স ডে'। স্কুলে, ক্লাবে বাগদেবীর আরাধনার সঙ্গে সঙ্গে শহরের বুকে অজস্র 'প্রেম' গড়ে ওঠার সাক্ষী থাকে সরস্বতী পুজো। এই শহরে দুর্গাপুজোর পর বোধহয় সরস্বতী পুজোর জৌলুসই সবচেয়ে বেশি। প্রথম দিকে ছবিটা কিন্তু এরকম ছিল না। টোল-চতুস্পাঠীগুলোতে দেবী পূজিতা হতেন পাতায় পটে। সেখান থেকে জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবে উত্তরণ ঘটেছে কিন্তু 'বাবু সমাজ'এর হাত ধরেই। ইংরেজি শিক্ষিত বাবু সমাজের নানান কাজের মতোই যুগপৎ নিন্দিত ও নন্দিত কলকাতায় সরস্বতী পুজোর ইতিহাস।
ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা করে যেসমস্ত বাঙালি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন আর দুহাতে সেসমস্ত অর্থ খরচ করতেন তাঁরাই পরিচিত ছিলেন 'নববাবু' নামে। আর বাবু সমাজে কৌলীন্য নির্ভর করত উপপত্নী পোষণের উপর। এঁরা 'নববিবি' আখ্যা পেয়েছিলেন। আর এভাবেই শহরের বুকে গড়ে ওঠে 'নিষিদ্ধপল্লী'। জাঁকজমকপূর্ণ সরস্বতী পুজোর শুরু এই যৌনপল্লীতেই।
১৮৭২ সালে 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বঙ্কিমচন্দ্রের 'বাবু' প্রবন্ধ। আর সেখানে তিনি লিখেছেন, "যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন এবং পাঁঠার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু।" এই বাবুদের সৌজন্যে অধিকাংশ পতিতালয়েই খুব জাঁকজমক করে হত সরস্বতী পুজো। পরিস্থিতি এমন যে "কুমোরটুলির নগ্দা সরস্বতীরা বেধড়ক বিক্রি হয়ে মুটের মাথায় উঠ্চেন, কুমোরেরা শেষকালে আর জোগাতে না পেরে, বাড়তি দোমেটে করা জগদ্ধাত্রী ঠাকুরুনের হাতি ও সিঙ্গি ভেঙে দুখানি হাত কেটে ও ঘাড় বেঁকিয়ে সাদা করে স্থান পূর্ণ কচ্চে।" (হুতোম প্যাঁচার নকশা, কালীপ্রসন্ন সিংহ)।
হিন্দু সমাজে গেল গেল রব উঠল। ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় 'সমাজ কুচিত্র' নকশায় (১৮৬৫) বলেছেন, "কলকেতা সহরের সকলই সৃষ্টিছাড়া। এখানে গৃহবাড়ির চেয়ে বেশ্যাবাড়িতে সরস্বতী পুজোর সংখ্যা ও জাঁকজমক শতগুণে অধিক।" কিন্তু স্বয়ং কুবেরের হাত আছে যে বাবুদের মাথার উপর তাঁরা চাইলেই তেত্রিশ কোটি দেবদেবীকে যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারেন। এতে আর বলার কী আছে?
আরও পড়ুন
মৃতপ্রায় সরস্বতী নদীকে বাঁচাতে বাঁধের পরিকল্পনা
বাগদেবী সরস্বতীর সঙ্গে কামদেব মদনের সম্পর্ক অবশ্য নতুন নয়। বাৎস্যায়নের 'কামসূত্র' মতে চৌষট্টি কলা শিক্ষার শুরু হয় সরস্বতী পুজোর দিন। কলকাতার যৌনপল্লীতেও বহু মেয়ের হাতেখড়ি হত এইদিন। এই বিদ্যার নাম ছিল ছয়'ছ' বিদ্যা। এই ছয়টি 'ছ' হল - ছলনা, ছেনালি, ছেলেমি, ছাপানো, ছেমো, ছ্যাঁচড়ামি। নতুন মেয়েদের 'নববিবি'সুলভ নামকরণ অনুষ্ঠানও হত এই শুভদিনে। পুজোর দিন যৌনপল্লীতে বাবুদের ভিড় ভেঙে পড়ত। জাঁকজমকপূর্ণ আসরে বাবু গান ধরতেন আর তবলায় সঙ্গত করতেন 'নববিবি'। আর তার সঙ্গে চলত সবান্ধব তাসখেলা ও মদ্যপান।
আরও পড়ুন
সরস্বতী পুজো ঘিরে বিতর্কে রবীন্দ্রনাথ-সুভাষ, চাকরি খোয়ালেন জীবনানন্দ
ধর্মের কথা মাথায় রাখলে কিন্তু সরস্বতী অকৃত্রিম বৈদিক দেবী। তাঁর আরাধনায় এরকম 'নষ্টামি' যে সমাজ ভালো চোখে দেখেনি, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। 'সুলভ সমাচার' পত্রিকায় সমালোচনা করে লেখা হয়েছিল, "সন্তান কামনা করিয়া লোকে কার্তিক পূজা করে এবং বিদ্যালাভের জন্য সরস্বতী পূজা করে। বেশ্যাদের পক্ষে এ প্রকার কামনা নিতান্ত অনধিকার চর্চা, তথাপি তাহারা কার্তিক ও সরস্বতী পূজায় খুব ধুমধাম করিয়া থাকে।" 'আর্য্যদর্শন' পত্রিকায় বাঙালিদের উদ্দেশ্যে লেখা হয়, "সরস্বতী তোমার দুহিতা, কন্যাদায়ে তুমি সদাই বিব্রত, তাহাকে অন্যের ঘাড়ে ফেলিতে পারিলেই তুমি দায় হইতে নিষ্কৃতি পাও, তোমাকে নমস্কার।" বাঙালি কিন্তু কন্যাদায় থেকে নিষ্কৃতি চায়নি। আজকে আর বাবু সমাজ নেই। যৌনপল্লী থেকে সরস্বতী পুজোর পাট উঠে গেছে। কিন্তু সরস্বতী পুজোকে ঘিরে আয়োজনের আতিশয্যে কোথাও ভাঁটা পড়েনি।
আরও পড়ুন
অবশেষে কাজের স্বীকৃতি, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাচ্ছেন নদীয়া তাঁতশিল্পী সরস্বতী সরকার
ঋণ -
দেবাশিস পাঠক, আজকাল পত্রিকা
কলির শহর কলকাতা, হরিপদ ভৌমিক
Powered by Froala Editor