১৯৩৮ সাল, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক স্মরণীয় বছর। বাঙালিদের কাছে তো বটেই, সারা দেশের কাছেও। সেই বছরই জাতীয় কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে সভাপতিত্বের দায়িত্ব পালন করেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ঐতিহাসিক সেই অধিবেশনের প্রতিটা দলিল এক একটি সম্পদ। কিন্তু যে কাগজগুলোর উপর সই করেছিলেন নেতাজি, সেই কাগজের উৎস কজনই বা খোঁজেন! খুঁজতে গেলে পৌঁছে যেতে হয় রাজস্থানের এক প্রাচীন শহরে। শহরের নাম সাঙ্গানের। আজও যেখানে শহরের প্রায় সমস্ত মানুষের পেশা কাগজ (Paper Making) তৈরি করা। একেবারে হাতে তৈরি কাগজ, আমরা সবাই যাকে চিনি হ্যান্ডমেড পেপার (Handmade Paper) বলে।
কাগজমিলের সস্তার কাগজে যখন সমস্ত বাজার ছেয়ে ফেলেছে, তখনও এই হ্যান্ডমেড কাগজের চাহিদা নেহাত কম নয়। এখনও অনেক শৌখিন মানুষের নোটবুকের পাতায় দেখা যায় হাতে তৈরি কাগজ। বহু শিল্পী ছবি আঁকার জন্য বেছে নেন হ্যান্ডমেড পেপার। তাছাড়া নানা ধরনের শৌখিন সামগ্রীও তৈরি হয় এই কাগজ দিয়ে। কিন্তু তার ইতিহাসের খবর রাখেন না অনেকেই। শুরুটা হয়েছিল আজ থেকে ৫০০ বছর আগে। রাজপুতানায় তখন রাজা মান সিংহের শাসন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাতেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারতে এলেন একদল মানুষ। যাঁদের পেশাই কাগজ তৈরি করা। ভারতে এসে তাঁদের নাম হয়ে গেল কাগজি। এই কাগজিদেরই শহর সাঙ্গানের। বয়সে যা জয়পুর শহরের চেয়েও পুরনো।
এই কাগজ বানানোর পদ্ধতিটাও বেশ অন্যরকম। কাগজমিলের মতো এখানে গাছ কেটে কাগজ তৈরি করা হয় না। বরং কাগজ তৈরি হয় ফেলে দেওয়া জামাকাপড় থেকে। বিভিন্ন জায়গা থেকে এইসব জামাকাপড় সংগ্রহ করে এনে প্রথমে তা পরিষ্কার করে নেওয়া হয়। তারপর সেই কাপড় কেটে ফেলা হয় খুব সূক্ষ্ম টুকরোতে। এখন অবশ্য এই কাজটা যন্ত্রেই হয়। তবে এক সময় ধারালো কাঁচি দিয়ে মানুষ হাতে হাতেই টুকরো করতেন এইসব কাপড়। আর টুকরো মানে তা এতই সূক্ষ্ম যে, তুলোর সঙ্গে পার্থক্য বোঝা যায় না। এরপর সেই তুলোর মতো সূক্ষ্ম কাপড়ের টুকরোগুলি ভালো করে জলে ভিজিয়ে নেওয়া হয়। জলে ভিজে যে মণ্ড তৈরি হয়, তা দিয়েই তৈরি হয় কাগজ। কাগজ তৈরি, তা শুকিয়ে নেওয়া— পুরো কাজটাই হয় হাতে হাতে।
এই কাগজ তৈরির মূল উপাদান অবশ্যই কাপড়। তবে তার সঙ্গে অনেক সময় আরও নানা উপাদান মেশানো হয়। কোনো কাগজে মিশিয়ে দেওয়া হয় সোনা বা রুপোর মতো উজ্জল ধাতুর গুঁড়ো। কোনো কাগজে আবার ফুলের পাপড়ি। এইসব কাগজের দামও সাধারণ কাপড় থেকে তৈরি কাগজের চেয়ে কিছুটা বেশি। সম্প্রতি নানা উদ্যোগের ফলে আবার নতুন করে বাজার ফিরে পাচ্ছে এই হারিয়ে যেতে বসা শিল্পটি। সাঙ্গানের শহরে কয়েক দশক আগে মাত্র দুটি কাগজের কারখানা ছিল। এখন সেখানে চারটি কারখানা তৈরি হয়েছে। প্রতিটি কারখানায় গড়ে প্রতিদিন ১০ হাজারটি কাগজ তৈরি হয়। বিক্রিও হয়ে যায় সবই।
আরও পড়ুন
পরিত্যক্ত প্লাস্টিক থেকেই বস্ত্রনির্মাণ, পথ দেখাচ্ছে রাজস্থানের কিশোর
তবে একসময় মিলের কাগজের একচেটিয়া ব্যবসার সামনে সত্যিই হারিয়ে যেতে বসেছিল এই শিল্প। আসলে ইংরেজদের এদেশে ব্যবসার অন্যতম পণ্যও ছিল কাগজ। তাই দেশীয় কাগজশিল্পকে তাঁরা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিলেন। ঠিক যেমন বাংলার বস্ত্র শিল্প হারিয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশ শাসনে। তবে সাঙ্গানের শহরের কাগজ শিল্প পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার আগেই শুরু হয়ে যায় স্বদেশি আন্দোলন। গান্ধীজির নেতৃত্বে তা এক বৈপ্লবিক চেহারা নেয়। আর এই সময়েই নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় কাগজ শিল্প। গান্ধীজি নিজে হাতে তৈরি এইসমস্ত কাগজই ব্যবহার করতেন। ১৯৩৮ সালে হরিপুরা কংগ্রেসেও কাগজের জোগান দিয়েছিলেন সাঙ্গানের শহরের কাগজিরাই। এরপরেও কংগ্রেসের বেশ কিছু অধিবেশনে কাগজ দিয়েছিলেন তাঁরা। আজও গান্ধীজির সবরমতী আশ্রমের বইখাতা থেকে শুরু করে সমস্ত কাজে ব্যবহার করা হয় হাতে তৈরি এই কাগজ। আর শৌখিন মানুষের নতুন পছন্দের সঙ্গী হয়ে আবার নতুন করে সাধারণের ঘরে ঢুকে পড়তে চলেছে হ্যান্ডমেড পেপার।
আরও পড়ুন
প্যারালিম্পিক শ্যুটিং-এ স্বর্ণপদক, ইতিহাস গড়লেন রাজস্থানের অবনী
Powered by Froala Editor