“একটা সময়ে লেটারপ্রেসে ছাপা হত। সেখান থেকে আজকে আমরা ডিজিটালের দিকে হাঁটছি। এই পরিবর্তনটা বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের নান্দনিকতায় কী প্রভাব ফেলল, সেটা নিয়ে একটা কাজ শুরু করেছিলাম। সেটা আজ থেকে বছর পাঁচ-ছয়েক আগে। সেই কাজটা করার সময়, একাধিক জায়গার পাশাপাশি দার্জিলিং-এও যাই। দার্জিলিং যাওয়ার পর ওখানকার ছাপাখানা এবং মুদ্রণের ইতিহাসটার বিষয়ে ধীরে ধীরে জানতে পারি।”
বলছিলেন সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম সাহিত্য পত্রিকা ‘বোধশব্দ’-এর সম্পাদক এবং লেখক সুস্নাত চৌধুরী। দার্জিলিং-এর মুদ্রণেতিহাস, তার বিবর্তন নিয়েই এবার আস্ত একটি গ্রন্থ প্রকাশ পেতে চলেছে ‘বোধশব্দ’ থেকে। ‘পাহাড়ি প্রেস’। আর প্রকাশিতব্য এই গ্রন্থের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে সম্পাদক-লেখক সুস্নাত চৌধুরীর অক্লান্ত পরিশ্রম, গবেষণা ও অনুসন্ধান। কিন্তু হঠাৎ দার্জিলিং-এর এই মুদ্রণেতিহাসের অনুসন্ধানের কারণ কী?
সুস্নাত চৌধুরী জানালেন, “বইমেলায় কিংবা লিটল ম্যাগাজিন মেলায় আমাদের বিভিন্ন জেলার পত্রপত্রিকারা অংশ নেয়। আশ্চর্যের বিষয় হল, দার্জিলিং জেলার পার্বত্য এলাকার প্রতিনিধিত্ব সচরাচর চোখে পড়ে না। তার একটা কারণ হয়তো সেগুলো ইংরাজি বা নেপালি ভাষায় ছাপা হয়। কিন্তু বাংলার পাশাপাশি অন্যান্য ভাষার পত্রপত্রিকা কি থাকে না বইমেলায়? তো পাহাড়ের এই রহস্যটা কী— সেটা খুঁজতেই দার্জিলিং-এ যাওয়া।”
আরও পড়ুন
কলকাতার বুকে ‘লেখক ব্যাঙ্ক’, তিন দশক আগে উদ্যোগ নিয়েছিলেন সন্দীপ দত্ত
উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকেই কলকাতায় শুরু হয়ে গিয়েছিল মুদ্রণের কার্যকলাপ। এমনকি ১৮১৮ সালে প্রকাশ পায় বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’। দার্জিলিং-এ মুদ্রণের শুরু এরও বহু পরে। কথায় কথায় জানা গেল, ১৮৩৫ সাল নাগাদ সিকিম রাজার কাছ থেকে দার্জিলিং-এর ক্ষমতা পায় ব্রিটিশরা। কলকাতার বাইরে দার্জিলিং-ই সেসময় হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশদের দ্বিতীয় দফতর। তারও প্রায় তিন দশক পরে ১৮৬৯-৭০ সাল নাগাদ ছাপাখানার পথ চলা শুরু দার্জিলিং-এ। তা ব্রিটিশদের হাত ধরেই। সেসময় সেখানে প্রকাশিত হত ‘দার্জিলিং নিউজ’ নামের একটি সাপ্তাহিক ইংরাজি সংবাদপত্র। তারপর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রেস। জন্ম নেয় বহু ভাষার পত্রপত্রিকা।
আরও পড়ুন
তিনটি বইয়ের প্রতিটি শব্দেরই আদ্যক্ষর ‘ক’, অভিনব সাহিত্য রচনা বাঙালি লেখকের
“ভৌগলিকভাবে দার্জিলিং ছোট্ট একটা শহর। কিন্তু মুদ্রণকে কেন্দ্র করে বহুভাষিক অঞ্চল হয়ে ওঠে দার্জিলিং। ভুটিয়া, লেপচা, নেপালি, হিন্দি এবং একই সঙ্গে বাংলা রয়েছে সেখানে। সেইসঙ্গে বহু ইউরোপিয়ান ভাষা ইংরাজি, জার্মান, ফ্রেঞ্চ; এবং তিব্বতের সঙ্গে যোগ থাকায় তিবেতিয়ান ভাষারও প্রভাব ছিল। এইটা খুব বড়ো প্রভাব ফেলেছিল দার্জিলিং-এ। নানা ভাষায় সেখানকার প্রেসগুলিতে ছাপা হত”, জানালেন সুস্নাত।
আরও পড়ুন
মাদাগাস্কারে ভারতীয় লেখকদের বই নিয়ে স্ট্রিট লাইব্রেরি
তবে শুধু ব্রিটিশরাই নয়, এই মুদ্রণশিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন সেখানকার স্থানীয় মানুষজনও। এবং সেই পরিবর্তনটাও হয় খুব দ্রুত। দার্জিলিং-এ প্রথম প্রেস শুরুর প্রায় বছর দশ-পনেরোর মধ্যেই স্থাপিত হয় একাধিক নেপালি এবং বাঙালি-নিয়ন্ত্রিত ছাপাখানা। সেইসঙ্গে ব্রিটিশদের সরকারি প্রেস তো ছিলই। প্রশ্ন থেকে যায়, এত এত প্রেস হঠাৎ করেই কি হারিয়ে গেল দার্জিলিং-এর বুক থেকে? আর তার কারণই বা কী?
স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন সুস্নাত, “পাহাড়ি এলাকার যে ভূপ্রকৃতিতে ছাপার কাজ করা বেশ সমস্যাজনক। তখন ছাপার কাজ হত মূলত লেটারপ্রেস মেশিনে। এরকম ভারি যন্ত্র পাহাড়ের ওপরে নিয়ে যাওয়াটাই বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। পাশাপাশি টাইপ জোগাড় করাও মুশকিলের কাজ ছিল। যে কারণে, দার্জিলিং-এ প্রেস তৈরি হতেও দেরি হয়েছে অনেকটা। আর এই প্রেসগুলি বেশ লাভজনক ছিল, এমনটা নয়। সেই কারণে একাধিকবার মালিকানা বদল হতেও দেখা গেছে সেখানে। এবং সেভাবেই বহু প্রেস বন্ধ হয়ে গেছে।”
তবে সব প্রেসই যে একেবারে হারিয়ে গেছে তেমনটা নয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, বিশ শতকের শুরুর দিকে নেপালি শিক্ষাবিদ পরশমণি প্রধানের তৈরি প্রেস টিকে রয়েছে এখনও। প্রযুক্তি বদলেছে, তবে পুরনো যন্ত্রাদি, টাইপ এখনও সযত্নে সংরক্ষিত রেখেছেন সে প্রেসের বর্তমান মালিক তথা পরশমণি প্রধানের নাতি উদয়মণি প্রধান। কিন্তু পার্বত্য ছাপাখানার এই দীর্ঘ ইতিহাস এতদিন দৃষ্টির অগোচরে রয়ে গেল কেন? সহজভাষায় বলতে গেলে, অস্বীকার করার জায়গা নেই, খানিকটা অবহেলারই শিকার দার্জিলিং-এর এই ইতিহাস।
প্রকাশিতব্য বই-এ দার্জিলিং-এর এই বিস্মৃত সময়রেখা ধরেই হেঁটেছেন সুস্নাত চৌধুরী। সংগ্রহ করেছেন ইতিহাসের বিভিন্ন খণ্ডচিত্র। তবে তাঁর এই গবেষণামূলক গ্রন্থের সবথেকে আকর্ষণীয় বিষয় হল, প্রকাশিতব্য বইটিতে রয়েছে দুটি খণ্ড— ‘পাঠ’ ও ‘প্রদর্শনী’। যার প্রথম গল্প শোনাবে পুরনো পার্বত্য ছাপাখানার এবং দ্বিতীয় খণ্ডটি ছবি, আলোচনা নিয়ে স্বতন্ত্র একটি প্রদর্শনী। আর কিছুদিনের অপেক্ষামাত্র। তারপরেই দার্জিলিং-এর রহস্যময় মুদ্রণ ইতিহাসের শুলুকসন্ধান করা যাবে ‘পাহাড়ি প্রেস’-এর হাত ধরেই…
Powered by Froala Editor