১৭৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর, বাঙালির বিনোদনের ইতিহাসে একটা অক্ষয় দিন। ২৫ নং ডোমতলা লেনে প্রথম মঞ্চস্থ হল বাংলা নাটক। চারদিক খোলা যাত্রাপালা নয়, বাঙালি সাক্ষী থাকল একদম স্টেজ-উইং-ব্যাক নিয়ে হাজির পূর্ণাঙ্গ প্রসেনিয়াম থিয়েটারের। আর সেই বিপ্লবের কাণ্ডারি এক রুশ ভবঘুরে, লেবেডফ। সেই ঐতিহাসিক নাটককে নিয়ে অবশ্য পরবর্তীকালে কম আলোচনা হয়নি। আমরা বরং নজর রাখব নাটকের বিজ্ঞাপনের একটি লাইনের উপর।
"বেলাতি আর বাঙালি জনত্রের সহিত গিতবাদ্য হইবেক –
শ্রী ভারতচন্দ্র রায়ের কবিতা জনত্রের গান হইবেন –"
বিজ্ঞাপনের ভাষায় একটু খটকা লাগতে পারে। আসলে ২৩ বছরের রামমোহন তখনও কলকাতায় আসেননি, গদ্য রচনা তো দূরস্থান। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের যাত্রাও শুরু হয়নি। অতএব লেবেডফের সামনে তখন বাংলা গদ্যের কোনো আদর্শ উপস্থিত নেই। কিন্তু বিকৃত বানানেও 'যন্ত্র' শব্দটি দৃষ্টি এড়ায় না। এবং সে যন্ত্র খাঁটি বিলাতি যন্ত্র, পিয়ানো। ভারতচন্দ্র রায়ের বিদ্যাসুন্দর কাব্যের কয়েকটি ছত্রে সুরারোপ করে লেবেডফ উপস্থাপন করেছিলেন। সঙ্গত দিয়েছিল পিয়ানো। এমনকি আধুনিক গানের মতো তার মাঝে মাঝে ছিল ইন্টারলিউড। সর্বসাধারণের সামনে বোধহয় পিয়ানোর আত্মপ্রকাশ সেই প্রথম। পরবর্তীকালে যে যন্ত্রের সঙ্গে বাঙালির এক নিবিড় যোগাযোগ গড়ে উঠবে। বাড়িতে একটি পিয়ানো হয়ে উঠবে আভিজাত্যের প্রতীক।
ইতিহাসের নিরিখে কিন্তু পিয়ানো যন্ত্রটির থেকে শহর কলকাতা বেশ পুরনো। জব চার্নকের নৌকো যখন সুতানুটির ঘাটে এসে ভিড়েছিল, লন্ডনে তখনও হারপসিকর্ডের মূর্ছনা শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রেখেছে। আর কলকাতায় পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম থেকে বেরিয়ে ইংরেজ রাইটাররা মাঝে মাঝে নৌকো বিলাসের মধ্যে গান ধরতেন খালি গলাতেই। হারপসিকর্ড বদলে পিয়ানো এল ১৭২০ সালে। প্রিন্স ফার্দিনান্দোর নির্দেশ মেনে ক্রিস্টোফরি তৈরি করলেন পাঁচ অক্টেভের পিয়ানো। লোডিভিসো গুস্টিনি সুর তুললেন সেই যন্ত্রে। লন্ডন আর শুধু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নয়, পিয়ানোরও রাজধানী।
এদিকে লন্ডনের পাশাপাশি কলকাতা হয়ে উঠছে সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য শহর। সেখানে কিন্তু এই বিপ্লবের ছায়া পড়ল অনেক পরে। আর সেই কাজটা করলেন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। কোম্পানির কাজ থেকে বিরতি নিয়ে হেস্টিংস যখন লন্ডনে ফিরলেন, তখনই পরিচিত হলেন এই যন্ত্রের সঙ্গে। তারপর ১৭৬৯-এ যখন আবার ভারতে এলেন, সঙ্গে করে নিয়ে এলেন একটি পিয়ানো। এরপর ১৭৭৩ সাল থেকে হেস্টিংসের হাতে একটু একটু করে বদলাতে থাকবে শহর কলকাতা। শুধুই ব্রিটিশ আর বাঙালি নয়, বহু জাতি বহু ভাষার এক সাংস্কৃতিক তীর্থ গড়ে উঠবে এখানেই। আর এইসব সাংস্কৃতিক চর্চার সঙ্গে একটু একটু করে জড়িয়ে পড়বে পিয়ানো।
আরও পড়ুন
ভারতের প্রথম ফারসি সংবাদপত্র বেরোল কলকাতা থেকে, প্রকাশক রাজা রামমোহন রায়
লন্ডন থেকে এদেশে আসতেন যাঁরা, তাঁদের অনেকের সঙ্গেই থাকত একটি ছোটো পিয়ানো। বিশেষ করে বাড়ির মহিলাদের সন্ধ্যার বিনোদন ছিল মূলত পিয়ানো। নিজেরাও যেমন বাজাতেন, তেমনই কেউ কেউ সঙ্গে নিয়ে আসতেন পিয়ানো শিল্পী। তেমনই এসেছিলেন মার্গারেট ফোক এবং সোফিয়া প্লাউডেন। মূলত হারপসিকর্ড শিল্পী হলেও দুজনেই এসেছিলেন পিয়ানো বাদক হিসাবে। আর তাঁদের হাতেই বাংলার পিয়ানো চর্চার আরও একটি দিক খুলে গেল। এতদিন পিয়ানো থেকে শুধুই বিলাতি সুর শোনা গিয়েছে। কিন্তু এই দুই শিল্পী একটু একটু করে দেশের নবাবি এবং রাজ দরবার থেকে সংগ্রহ করলেন দেশি সুর। নিজেদের উদ্যোগে তৈরি করলেন নোটেশন। তারপর ৭৭টি উর্দু আর ফারসি সঙ্গীত একত্রিত করে লিখলেন একটি সংকলন। সঙ্গে যুক্ত করলেন বহু শিল্পীর প্রতিকৃতি। যদিও কোনো অজ্ঞাত কারণে সেই পাণ্ডুলিপি আর ছাপাখানার মুখ দেখেনি, কিন্তু পিয়ানোতে সেইসব সুর শুনিয়েছেন অনেককেই। প্রথম পরিপূর্ণ নোটেশন সহ ৩০টি হিন্দুস্থানি গানের সুর গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল ১৭৮৯ সালে। 'ওরিয়েন্টাল মিস্কলেনি' নামের সেই বইয়ের লেখক উইলিয়াম হ্যামিল্টন বার্ড। ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের সম্পূর্ণ স্বরলিপি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ভারততাত্ত্বিক স্যার উইলিয়াম জোনস। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলেও তার উপর ভরসা রাখা যায় না। সময়ের অভাবে অজস্র ভুল করেছিলেন জোনস সাহেব।
আরও পড়ুন
২৪২ বছর আগে বাংলায় চিনা উপনিবেশ, অধরাই রইল ‘দ্বিতীয় কলকাতা’ তৈরির পরিকল্পনা
এই প্রসঙ্গে আরও এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করতেই হয়। তিনি আর কেউ নন, শ্রীরামপুর গির্জার উইলিয়াম কেরী। অবশ্য তাঁর কাজের সঙ্গে সরাসরি পিয়ানো যন্ত্রটির কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু বাইবেলের গসপেল থেকে গান বেছে সেগুলোর বাংলা অনুবাদ করে তিনি দুই দেশের সঙ্গীতের পৃথক ধারার মধ্যে একটা মেলবন্ধন ঘটাতে পেরেছিলেন। আঠেরো শতকে এভাবেই নানা স্তরে চলেছে ভারতীয় ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন। পরবর্তী শতকে যে কাজের দায়িত্ব মূলত নেবেন ভারতীয়রাই। আর এই মেলবন্ধনের ইতিহাসে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে পিয়ানো নামের যন্ত্রটি। বাঙালির সংস্কৃতি ও আভিজাত্যের প্রতীক এই যন্ত্রটাই আজ হয়তো অনেক বাড়িতে 'স্রেফ ফার্নিচার' হয়ে গিয়েছে। তার একেকটি কী থেকে এখন আর সুর না বেরোলেও, ইতিহাস বেরিয়ে আসবে নিশ্চিত।
আরও পড়ুন
কলকাতার নাম বদলে হল ‘আলিনগর’, ইংরেজদের শহর থেকে তাড়িয়ে ছাড়লেন সিরাজ
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
জোফানির আঁকা ‘দ্য লাস্ট সাপার’ লুকিয়ে আছে কলকাতাতেই, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের আদলে শিষ্যদের মুখ