নবাবি আমল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পলতা-ইছাপুরের কুখ্যাত ‘ফাঁসিডাঙা’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে সদ্য। উত্তর চব্বিশ পরগনার একটি মফস্‌সলি এলাকা—পলতায়, ব্রিটিশের যে আটখানা মিলিটারি ক্যাম্প বসেছিল, তা আপাতত শুনশান। ঘর ভেঙেছে, সঙ্গে খবরও রটেছে: আমবাগান আর লিচুবাগানে ঘেরা, চাঁচের বেড়া দিয়ে পার্টিশান করা মিলিটারি ক্যাম্প মেরামতির পরে, ঘরপ্রতি আটটাকায় ভাড়া দেওয়া হবে। কিন্তু, এমন ভয়ানক পরিবেশে থাকতে চাইবে কেউ? এখানে যে প্রায়ই রাতে, আমগাছ বা লিচুগাছের ডালে, অন্তত একজন মানুষকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়!

ফাঁসিডাঙা। পায়রাডাঙা, গোবরডাঙার মতো আরও একটা ডাঙা। উনিশশো ছেচল্লিশ, এমনকি তারও পরে কিছু বছর অবধি, ব্যারাকপুর থেকে শ্যামনগরগামী পঁচাশি নম্বর বাসরুটের নির্জন এক স্টপেজ, ফাঁসিডাঙা—পূর্বদিকে বিস্তারিত আমবাগান, তারপরে রেললাইন; পশ্চিমে বাসরাস্তা, বাসরাস্তার ওপারে পলতা এরোড্রাম; দক্ষিণে একের পর এক ডোবা এবং মাঠ; উত্তরে নলিনীরঞ্জন সরকারের কারখানা হিন্দুস্থান ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশান—কম্পাস, বিভিন্ন রকমের দম দেওয়া ঘড়ি তৈরি হয়। ভুল বললাম, ‘হয়’ না, ‘হত’। অর্থাৎ বর্তমানে নেই। ইতিহাসেও নেই। পুরাণে আছে, তাও সরাসরি ছুঁয়ে নেই। তবে কেমন সে ছোঁয়াছুঁয়ি? পুরোষত্তম, নারায়ণ দেব এবং বিজয় গুপ্তকে অতিক্রম করে বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের মনসামঙ্গলকে ধরা যাক।

অষ্টম পালা। স্বয়ং মনসা, শিবের রূপ ধারণ করে চাঁদ সদাগরকে স্বপ্নাদেশ দিলেন। বললেন, অনুপম-পাটনে নৌকো সাজিয়ে যেতে। সেখানে তিনি উপস্থিত হবেন। চাঁদ সদাগরের মহাজ্ঞান এবং ছয় মৃতপুত্রকে ফিরিয়ে দেবেন—এও আশ্বাস দিলেন। নবম পালা। বাণিজ্যযাত্রায় চলেছেন চাঁদ সদাগর। সর্বজয়া, জগদ্দল, সুমঙ্গল, নবরত্ন, চিত্ররেখা, শশীমুখী—সপ্তডিঙা ভাসছে। ভাসতে ভাসতে রাজঘাট-রামেশ্বর, অজয় নদী, ধর্মখাল, নদিয়া পেরিয়ে ইন্দ্রঘাটে এসে পৌঁছচ্ছে নৌবহর। তারপর আবার ভেসে চলেছে। চাঁদ সদাগরের এই যে সুদীর্ঘ জলপথের যাত্রা, প্রাচীন সমস্ত জনপদ ঘেঁষে বয়ে চলা, তার বর্ণনায় বিপ্রদাস পিপিলাই বলছেন:

‘চাপদানি ডাইনে, বামেতে ইছাপুর
বাহ বাহ বলি রাজা ডাকিছে প্রচুর…’

সিরাজ-উদ-দৌল্লাহ যে মহলে থাকতেন। নবাবগঞ্জ।

 

ইছাপুর! পলতার পিঠোপিঠি যে বেড়ে উঠেছে! অতএব এই উপপাদ্য প্রমাণের খাতিরে, বলা যেতেই পারে, পলতার কোনো ঘাটের জল নিশ্চয়ই চাঁদ সদাগরের সপ্তডিঙা ছুঁয়ে এসেছিল। ঘাটের নেশা ধরে গেছে তখনই। সে আবার কবে গায়ে মাখবে এমন রাজকীয় ছলাতছল? 

সতেরোশো পঁয়তাল্লিশ। নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লাহ’র নৌকো এসে ভিড়ল পলতা-ইছাপুরের অন্তর্গত গঙ্গার ঘাটে। ঘাটের কাছাকাছি তৈরি হবে মহল, গ্রীষ্মকালে এসে থাকবেন নবাব। তাই নাম হল নবাবগঞ্জ। ঘাটের ছলাতছলে তখন থেকেই নবাবিয়ানা। 

নবাবগঞ্জের আদি মানুষ, স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকেই যারা নবাবগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা, তাঁদের কেউ কেউ আশ্চর্য সব গল্প বলেন। সিরাজ-উদ-দৌল্লাহ যখন গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে এসেছেন নবাবগঞ্জে। সেইসময় কোনো অভাগার মৃত্যুদণ্ড হলে, তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হত যে ডাঙায়, তা-ই আসলে ফাঁসিডাঙা। ‘আশ্চর্য সব গল্প’ বলেছি, তার একমাত্র কারণ এ-ঘটনা মুখ থেকে মুখে সম্প্রচারিত।

বর্তমানে ঊষারঞ্জন চক্রবর্তীর বাড়ি

 

ফাঁসিডাঙা মিলিটারি ক্যাম্পে প্রথম যে উদ্বাস্তু পরিবার বাসা বেঁধেছিল, সে পরিবারের বড়োছেলে শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মারাত্মক এক ইতিহাস বলছেন। শোনা যায়, রেললাইনের আশেপাশে কোনও পাঞ্জাবি ডাকাতদল ঘাঁটি গেড়েছিল। সম্পূর্ণ জনশূন্য এলাকা। আলো নিভে এলে, পথচলতি মানুষ ধরে ধরে যথেচ্ছ লুঠপাট চালিয়েই তারা শান্ত থাকেনি। আমবাগানের ভেতরে, অসংখ্য ডোবার একটার ধারে তাদের নিয়ে গিয়ে, দড়ির একপ্রান্ত গলায় বেঁধে, আমগাছের ডালে ঝুলিয়ে দেওয়া হত। পায়ের নীচে ডোবা। অর্থ্যাৎ মৃত্যু অবধারিত। দড়ির অন্যপ্রান্ত ধরে রাখত ডাকাতদলের কেউ। তারপর সেই দড়ি টেনে টেনে সামান্য দূরের কোনো আমগাছের গোড়ায় বেঁধে তারা বুঝিয়ে দিত আত্মহত্যা নয়, এ আসলে খুন। 

ভয়ধরানো ঘন আমবাগান আর লিচুবাগান, অসংখ্য ডোবা আর হেলে সাপ, পাঞ্জাবি ডাকাত আর ফাঁসিতে ঝুলে থাকা অপাপবিদ্ধ মুখ আর অপরিসীম নির্জনতা—এরাই জড়িয়ে রেখেছিল ফাঁসিডাঙা।     

গুগল বলছে, পলতা কোনো শহর নয়। বরং ‘লোকালিটি’ বলে ডাকা যেতে পারে। চলতে চলতে একটু জিরিয়ে নিতে যতটুকু পরিসরের প্রয়োজন, সেটুকুই ধরা যাক পলতা। সেটুকুর মধ্যেই গড়ে উঠেছিল ‘মহালক্ষ্মী কটন মিল’, ‘বেঙ্গল এনামেল’-এর মতো কারখানা। ইছাপুরে রাইফেল ফ্যাক্টরি। দেশভাগের পরে, ওপার বাংলা থেকে পালিয়ে আসা মানুষ-মানুষীকে টিকে থাকতে সাহস জুগিয়েছিল এই কটন মিল, এই কারখানা, এই ফ্যাক্টরি। খিদিরপুরে উদ্বাস্তু দপ্তরে টাকা জমা করে, তারা প্রত্যেকেই মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে বেছে নিচ্ছিল মিলিটারি ক্যাম্পগুলো। উদ্বাস্তুর গন্ধ-স্পর্শ-যন্ত্রণায় ইতিহাসে যেমন জন্ম হচ্ছিল কলোনির, তেমনই ইতিহাস থেকে মুচ্ছে যাচ্ছিল ফাঁসিডাঙা। একা হয়ে যাচ্ছিল আমবাগান। মানুষ আর আমবাগান, লিচুবাগানকে ভয় পাচ্ছিল না। তখন সন্ধেবেলা নিয়ম করে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলতে শুরু করেছে ফাঁসিডাঙায়। আমবাগানে প্রথম জমি কিনলেন, ঊষারঞ্জন চক্রবর্তী। দ্বিতীয়, কেষ্ট কুণ্ডু।

বর্তমানে ফাঁসিডাঙা। রাস্তার বাঁ-দিকে বসেছিল মিলিটারি ক্যাম্প।

 

এখনও পর্যন্ত আর যা-কিছু বলেছি, লিখেছি, পলতা এরোড্রাম (বর্তমানে ভারতীয় এয়ার ফোর্সের অধীনস্থ) আর ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরি ছাড়া, সবই ছিল। আসলে অতীতচারণ ছাড়া গতি নেই। তবুও জীবনানন্দ লিখলেন, জীবন অগাধ। বেঙ্গল এনামেলের মৃতপ্রায় কারখানার সামনে দাঁড়ালে, মহালক্ষ্মী কটন মিলের ভগ্নাংশের দিকে তাকালে, কিম্বা কেষ্ট কুণ্ডুর প্রকাণ্ড বাড়ি ভেঙে যে ফ্ল্যাট উঠল— এতকিছুর মধ্যে নিজেকে একটা নাল সেটের মতো পুরে দিতে ইচ্ছে করে। আসলে প্রত্যেকেই একেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ সেট। আমি তাদের সঙ্গে কেবল জুড়ে আছি। না ছোঁয়ার মতো করে। আমার ভেতরটা শূন্য, ভয়েড—এ যেন আমার নিজস্ব তেলেনাপোতা। ‘শনি ও মঙ্গলের—মঙ্গলেই হবে বোধহয়—যোগাযোগ হলে’… আচ্ছা, যোগাযোগের ঠিকানা চাই? ১৯৯, আমবাগান, পলতা, পোস্ট অফিস: বেঙ্গল এনামেল, উত্তর চব্বিশ পরগনা।

ঋণ:
১. বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের মনসামঙ্গল, অচিন্ত্য বিশ্বাস
২. শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. অভিমন্যু দাস
৪. অতুলচন্দ্র ভৌমিক

Powered by Froala Editor