নেটফ্লিক্স (Netflix)। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই বিশেষ ওটিটি প্ল্যাটফর্মের নাম শোনেনি, এমন মানুষ গোটা ভূ-ভারতে খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। ‘উইচার, ‘মানি হাইস্ট’, ‘টুমরো’, ‘স্টেঞ্জার থিংস’ কিংবা ‘দ্য ব্ল্যাকলিস্ট’-এর মতো সিরিজের সৌজন্য ভারত তো বটেই, গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই রমরমা নেটফ্লিক্সের। ২০২৩ সালের হিসেব অনুযায়ী, সবমিলিয়ে তাদের ১৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা গোটা বিশ্বজুড়ে। গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ২৫ কোটি। তবে মজার বিষয় হল, ওটিটি দুনিয়ায় কিংবদন্তি হয়ে ওঠা সংস্থাটির সূত্রপাত হয়েছিল সামান্য একটি গাণিতিক সমস্যা থেকে।
এমনটা শুনলে খানিকটা অবাক হতে হয় বইকি। তবে শুরু থেকেই বলা যাক নেটফ্লিক্সের গোড়ার কাহিনি।
১৯৮০ সাল। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিটার সায়েন্স বিভাগের ক্লাস। অধ্যাপক হিসাবে ক্লাস নিচ্ছিলেন কিংবদন্তি গবেষক অ্যান্ড্রু টানেনবাউম। ক্লাসে উপস্থিত ছাত্রদের একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে দেন তিনি। কী সেই সমস্যা? আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ‘টেপ’-এর সঙ্গে অনেকেই পরিচিত নই আমরা। তবে সে-যুগে টেপই ছিল ‘সফট ডেটা’ বা তথ্য আদানপ্রদান করার অন্যতম মাধ্যম। অ্যান্ড্রুর দেওয়া প্রশ্নটা ছিল এই টেপকে কেন্দ্র করেই। ছাত্রদের এই টেপ পরিবহনকারী স্টেশন ওয়াগানের ব্যান্ডউইদথ নির্ধারণ করতে দিয়েছিলেন তিনি। সেইসঙ্গেই সেগুলি কত পরিমাণ তথ্য ধারণ করতে পারে এবং তথ্যগুলি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিতে কত সময় লাগবে— নির্ণয় করতে হবে সেটিও। কম্পিউটার প্রযুক্তির ভাষায় যাকে বলা হয় স্নিকারনেট।
এই গাণিতিক সমস্যার সমাধান বার করতে গিয়েই দ্রুতগতি-সম্পন্ন নেটওয়ার্ক তৈরির কথা মাথায় আসে এক তরুণ কম্পিউটার প্রযুক্তিবিদের। তাঁর নাম রিড হেস্টিংস। হ্যাঁ, আজ যাঁকে আমরা চিনি নেটফ্লিক্সের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে। সেদিন এই গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে গিয়েই তাঁর মনে হয়েছিল, টেপকে অনায়াসেই বদলে দেওয়া যেতে পারে ডিভিডি-র মাধ্যমে। তা একদিকে যেমন সাশ্রয়ী। তেমনই টেপের তুলনায় অনেক, তা বেশি পরিমাণ তথ্য ধরে রাখতে সক্ষম। একাধিক ব্যবহারকারী কোনো একটি ডিভিডিকে ব্যবহার করলেও সচরাচর ক্ষতি হয় না তার।
যদিও এই ভাবনা সুপ্ত অবস্থাতেই ছিল তাঁর মনের মধ্যে। নেটফ্লিক্স প্রতিষ্ঠা হতে লেগে যায় আরও ১৭ বছর। উচ্চশিক্ষা এবং বেশ কিছু বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করার পর ১৯৯১ সালে নিজেই একটি প্রযুক্তি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন হেস্টিংস। ‘পিওর সফটওয়্যার’ নামে পরিচিত এই সংস্থা সে-সময় কম্পিউটার সফটওয়্যার এবং প্রোগ্রামিং-এর কাজ করত। তবে তাতে যে বড়ো অঙ্কের লাভ হত, এমনটা নয়। ফলে, বিকল্প উপার্জনের চিন্তাভাবনা শুরু করেন হেস্টিংস। ১৯৯৭ সালে এই কোম্পানির লভ্যাংশ থেকেই শুরু হয় নেটফ্লিক্সের পথচলা। বন্ধু মার্ক র্যান্ডলফের সঙ্গে ব্যবসায়িক গাঁটছড়া বাঁধেন রিড। অবশ্য ‘ওটিটি’ নয়, বরং নেটফ্লিক্স সে-সময় বিভিন্ন সিনেমা, সিরিজ ও গানের ডিভিডি ভাড়া দিত গ্রাহকদের।
হ্যাঁ, সে-যুগে ডিভিডি-ই ছিল ঘরোয়া বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। ফলে, সেটিকেই ব্যবসার ক্ষেত্রে পরিণত করেন রিড। অবশ্য সে-যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুকে এ-ধরনের ডিভিডি ভাড়া পাওয়া যাওয়ার বহু দোকান, সংস্থার অভাব ছিল না কোনো। পাশাপাশি ভিএইচএস বা ভিডিও হোম সিস্টেমও জনপ্রিয় ছিল। এসবের মধ্যে নিজের সংস্থাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে নতুন পরিকল্পনা করেন রিড। খবরের কাগজে বড়ো বড়ো করে বিজ্ঞাপন দেন, ডিভিডি সংগ্রহের জন্য আর দোকানে যেতে হবে না। বরং, বাড়িতে বসে অর্ডার দিলেই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে পৌঁছে যাবে ডিভিডি।
প্রাথমিকভাবে ক্যালিফোর্নিয়ায় এই পরিষেবা চালু হলেও, অল্পদিনের মধ্যেই গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে নেটফ্লিক্সের এই নতুন প্রকল্প। সে-সময় মাত্র ২০ মার্কিন ডলার খরচ করলেই হওয়া যেত নেটফ্লিক্সের মাসিক গ্রাহক। তাতে নিজের পছন্দ মতো যে-কোনো সিনেমার ডিভিডিই বাড়িতে পেয়ে যেতেন গ্রাহকরা। মেইল অর্থাৎ ডাক বিভাগের মাধ্যমেই পাঠানো হত সেই ডিভিডি। কোনো বিশেষ সিনেমার ডিভিডি ফিরত পাঠালে, নতুন সিনেমার ডিভিডির জন্য আবেদন করতে পারতেন গ্রাহকরা। পরবর্তী এক দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে কানাডা, মেক্সিকো এবং ইউরোপেও রীতিমতো ব্যবসা ফেঁদে বসে নেটফ্লিক্স। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৯৭-২০০৭— মাত্র ১০ বছরের মধ্যে নেটফ্লিক্সের গ্রাহকের সংখ্যা পৌঁছেছিল ১০০ কোটিতে। কিন্তু কীভাবে ‘ওটিটি’ প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠল এই সংস্থা?
এক্ষেত্রে রিড এবং মার্কের দূরদর্শিতার কথাও বলতে হবে আলাদা করে। নব্বইয়ের দশকে শেষদিকে, যখনও পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কাছে ইন্টারনেট পৌঁছায়নি গণহারে, ছিল না স্মার্টফোন বা কম্পিউটার— সে-সময়ই নেটফ্লিক্সের ‘ওটিটি’ হয়ে ওঠার বীজবপন করেছিলেন রিড ও মার্ক। স্বল্প মূল্যে কিনে রেখেছিলেন ‘নেটফ্লিক্স’-এর নামে একটি বাণিজ্যিক ইন্টারনেট ডোমেইন।
প্রথম দশকের শেষের দিকে পাশ্চাত্য এমনকি এশিয়াতেও ধীরে ধীরে ইউটিউব জনপ্রিয় হতে শুরু করলে এই ইন্টারনেট ডোমেইনকেই ‘ওটিটি’ প্ল্যাটফর্মে বদলে ফেলেন রিড। অবশ্য ‘ওটিটি’ কথাটা যথোপযুক্ত নয় এক্ষেত্রে। নেটফ্লিক্স সে-সময় চালু করেছিল ‘ভিডিও অন ডিম্যান্ড’ নামের এক বিশেষ স্ট্রিমিং সার্ভিস। গ্রাহকদের আবেদন বিশেষ বিশেষ কিছু সিনেমা দেখানো হত তাদের ওয়েবসাইটে। যদিও এই পরিষেবার মধ্যে সে-সময় দেখানো হতে বড়োজোর ১০০০টি সিনেমা, যেখানে প্রায় ৭০ হাজার সিনেমার ডিভিডি পাওয়া যেত ডাকযোগের মাধ্যমে।
২০১০ সাল। টোয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফক্স, ওয়ার্নার ব্রাদার্স, প্যারামাউন্ট, লায়নসগেট-সহ বেশ কিছু খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র প্রযোজক সংস্থার সঙ্গে বিশেষ চুক্তি করে নেটফ্লিক্স। ঠিক হয়, তাদের তৈরি বিশেষ বিশেষ সিনেমা, সিরিজ দেখানো হবে নেটফ্লিক্সে। সে-সময় গ্রাহকদের মধ্যে এই পরিষেবা জনপ্রিয় করে তুলতে সাবস্ক্রিপশনের খরচও ডিভিডি পরিষেবার থেকে কম রেখেছিল নেটফ্লিক্স। মাত্র ৭ ডলার মাসিক ফি-তেই দেখা যেত পছন্দের সিনেমা। পাশাপাশি হলে মুক্তি পাওয়ার মাত্র ২৮ দিনের পরই, নতুন সিনেমা চলে আসত নেটফ্লিক্সে।
বলাই বাহুল্য, এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি নেটফ্লিক্সকে। সিনেমার বাইরে সেখানে জায়গা করে নেয় কার্টুন ও ধারাবাহিকও। ২০১১ সালে সর্বপ্রথম যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে কানাডায় শুরু হয় এই অনলাইন পরিষেবা। তারপর ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রগুলিতেও। এমনকি গত দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে নিজস্ব সিনেমা ও সিরিজ তৈরিতেও জোর দেয় নেটফ্লিক্স। হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। এমনকি বর্তমানে শুধু মার্কিন কন্টেন্টই নয়, বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট ও নাগরিকদের পছন্দকে মাথায় রেখে সেই ভিত্তিতেও নিত্যনতুন চলচ্চিত্র, সিরিজ তৈরি করে চলেছে নেটফ্লিক্স। অথচ, আজকের ব্যবহারকারীরা ক’জনই বা খোঁজ রেখেছে নেটফ্লিক্স গড়ে ওঠার সেই কাহিনি? আশ্চর্যের বিষয় হল, আজ নেটফ্লিক্স চূড়ান্ত সাফল্যের জায়গায় পৌঁছালেও এই সংস্থার সঙ্গে জুড়ে নেই অন্যতম প্রতিষ্ঠা রিড হেস্টিংস। গত ফেব্রুয়ারি মাসেই এক বিতর্কের কারণে পদত্যাগ করেন তিনি। অবশ্য তাতে বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়েনি নেটফ্লিক্সের এই জয়যাত্রায়।
Powered by Froala Editor