সাতের দশকে, কৃষ্ণনগর থেকে গোটা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল যে ‘ভাইরাস’

‘ভাইরাস’ আমি খালি চোখেই দেখেছি। অবশ্য তা যখন বাংলা কবিতার শরীরে ‘কামড় বসাচ্ছে’, সেইসময় নয়। তার ঢের পরে, কবি মৃদুল দাশগুপ্তের সৌজন্যে। কিন্তু মরা হাতিই শুধু নয়, মরা ভাইরাসও যে লাখ টাকার সমান, তা এই ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া হলদেটে পাতাগুলো ওলটালে বুঝতে পারা যায়।

একটি হাফ-ডিমাই কাগজ মাঝামাঝি ভাঁজ করা। কোনো প্রচ্ছদ নয়, সুতো বা পিনে বেঁধে রাখাও নয়। প্রথম পাতায় ব্লকে ছাপা মাস্টহেড, আগাগোড়া লেটারপ্রেসে। কৃষ্ণনগর থেকে প্রকাশিত, চার পাতার খোলা কাগজ। চার পাতা জুড়ে আসলি বাংলা কবিতার ইনফেকশন।

১৯৭৬ সালের জানুয়ারি সংখ্যাটির প্রথম পাতা জুড়ে ‘সুবোধচন্দ্র সরকারের বারোটি কবিতা’। শেষ পাতায় বীতশোক ভট্টাচার্যের ‘যযাতি’, প্রদীপ দাশশর্মার ‘কুকুর’, জয় গোস্বামীর ‘গোধূলী’, মৃদুল দাশগুপ্তর ‘গোপন ভারতবর্ষ’ আর অজিত বাইরির ‘জামসেদপুরের কবিকে’। তখন এক নতুন বাংলা কবিতা তৈরি হওয়ার সময়। এই সংখ্যারই ‘এক টুকরো গদ্য’ বলছে—

“…আমরা ভালো কবিতা পাচ্ছি কিন্তু নতুন কবিতা পাচ্ছিনা। অথচ আশ্চর্য, ক্ষুদে কাগজে প্রতিষ্ঠিতদের কবিতা থাকেনা, তরুণরাই লেখেন, অথচ এটা হয় কি করে? সবাই কি ভালো ভালো কবিতা লেখার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন আজকাল?

…গা ঘিন ঘিন করা সফিষ্টিকেটেড স্মার্টনেস আর ভাল্লাগে না— কবিতা কি বাবুদের বাড়ির সুখী কন্যার স্পর্শ কাতর ঠোঁটের পুষ্টির জন্যে পেটেন্ট হবে, না আমাদের মূল্যবোধ গুলোকে উত্তাপ দিয়ে ঋজু করে দিয়ে যাবে— এই মুহূর্তে এটা ঠিক করে নেওয়া ভালো।

…ভালো কবিতার আর দরকার নেই, খুব হয়েছে, কেননা তা দিয়ে আর কি হবে, আমরা স্বদেশী বিদেশী প্রতিষ্ঠিত কবিদের বই কিনে পড়লে নিশ্চিত ভাবে তা পাব। নতুন কবিদের কাছ থেকে আমরা চাই যুগ পরিবর্তনের কবিতা, নতুন আবহের কবিতা, ক্রমে যা নতুন ভালো কবিতা হবে, এবং কবি-যশো-প্রার্থীদের থেকে কবিদের আলাদা করে চিনে নিতে সাহায্য করবে। কবিতার ছোটো কাগজের এই-ই দায়।”

সাতের দশকের এই লিটল ম্যাগাজিন শুরুতেই তার স্টান্স স্পষ্ট করে দিয়েছিল। প্রিয় বিশ্বাস ও দেবদাস আচার্য সম্পাদিত ‘ভাইরাস’ শেষতক সেই অবস্থান ধরেও রেখেছিল। ‘ভাইরাসের গদ্য’ শিরোনামে দেবদাস আচার্যর এক-আধ পাতার লেখাগুলি আজও যেন এক-একটা রাজনৈতিক ইস্তেহার! ন্যাকা কাব্যচর্চার ভ্যাদকা শরীরে চালানো চাবুক-বিশেষ! ধান্দাবাজির মুখোশ ধরে অতর্কিত হ্যাঁচকা! তবে সেদিন যেসব তরুণ কবির উপরে বাজি রেখেছিল ‘ভাইরাস’, এইসব কথাগুলি কি তাঁরা সবাই ভিতর থেকেই বিশ্বাস করেছিলেন? আজও করেন?

যেমন, ১৯৭৭ সালের জুন সংখ্যায় ‘হা কবি’ শিরোনামের লেখাটি শুরু হচ্ছে এইভাবে—

"মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী বলে কথিত এক শ্রেণীর পাঠকই কবিতার পাঠক, এবং আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাদের একেবারে বিশ্বাস করিনা। তারা কবিতা চর্চাকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায় তাদের সংকীর্ণতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ বাড়াবার অনুশীলনে। আমি আমার সামান্য অভিজ্ঞতা থেকেই জানি যে, তাদের সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে পাপ লুকিয়ে থাকে। তাদের কৌলিন্য বাড়ানোর জন্যে এমনকি তারা নজরুল-জয়ন্তী পর্যন্ত পালন করেন, অথচ, কবি হতভাগারা কি জানেন যে, তারা সমাজের এক বিশ্রী, কূপমণ্ডুক, অনুদার, তৃতীয় শ্রেণীর মানুষের সেবায় নিযুক্ত আছেন? কবিতার বই, সে কারণেই, বেশি বিক্রী হচ্ছে শুনলে আমার ভয় হয়!…"

এই ধাক্কাটাই দিতে চেয়েছিল ‘ভাইরাস’। হয়ে উঠেছিল বাংলা কবিতার এক চোরা সন্ত্রাসের নাম। অল্প কয়েক বছর সে বেঁচেছিল। কিন্তু তার সংক্রমণের প্রত্যক্ষ অভিঘাত ছিল দীর্ঘস্থায়ী। দেবদাস আচার্য নিজেই সম্প্রতি একটি লিটল ম্যাগাজিনে এই পত্রিকার নামকরণ প্রসঙ্গে লিখেছেন— ‘‘…‘ভাইরাস’ একটা কবিতার কাগজের নাম, এটা একটু বিরক্তিকর বটে। কবিতার কাগজের নাম ‘অ্যান্টিপোয়েটিক’ হোক, এটাই আমি চেয়েছি। ‘ভাইরাস’-ই-বা কেন? সেটাও এই কারণে যে, কাগজটি দ্রুত ‘সংক্রামক’ হোক। কবিতায় সংক্রমিত হোন কবি ও পাঠকগণ। ভাইরাস একেবারে নাছোড় রোগ। কোনো ওষুধ নেই তাকে কবজা করার। ক্ষুদ্রকায়, আণুবীক্ষণিক কিন্তু মহাশক্তিমান, স্বেচ্ছামৃত্যুই তার পরিণতি ইত্যাদি। ব্যাপারটা গোছালে এমন দাঁড়ায় যে— নানা দিক থেকেই কাগজটি প্রথাবিরোধী হয়ে উঠুক। সাহসী ও শক্তিমান কবিদের প্রিয় কাগজ হয়ে উঠুক।’’ একদিন তা হতে পেরেছিল ‘ভাইরাস’। আজও যে বাংলা কবিতাকে দেখি, তার ভিতরেও কি ঘাপটি মেরে বসে নেই, মাঝেমধ্যে কি নিজেকে চিনিয়ে দেয় না সেই কালো বিষ!